The news is by your side.

অশান্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প: সক্রিয় হয়ে উঠেছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ

0 208

 

কক্সবাজার অফিস

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ১০—১৫টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। দিনে দুপুরে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক সরবরাহ, মানবপাচার ও অস্ত্রের ঝনঝনাতিতে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে তারা। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কেউ কেউ গ্রেপ্তার  হলেও পাহাড়ের নির্জন এলাকায় আস্তানা গড়ে তোলায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে বেশির ভাগ অপরাধী।

১০আগস্ট জামতলি এফডিএমএন ক্যাম্প—১৫—এর সি ব্লকের হেড মাঝি আবু তালেব (৫০) এবং সাব—মাঝি  সৈয়দ হোসেন (৪৩) মাঝিসহ  শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় আবারো আলোচনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পের মধ্যে জোড়া দুই মাঝিখুনসহ মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন বলা হলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র দাবি করছে, দেশের অভ্যন্তরীণ শীর্ষ জঙ্গি সংগঠনগুলোর অন্যতম টার্গেট এই রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সদস্য রিক্রুট করার জন্য শীর্ষ জঙ্গি নেতারা নিয়মিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৈঠক করছেন বলে জানা যায় । জঙ্গি নেতাদের ইন্ধন দিচ্ছে-  রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা, আল ইয়াকিনসহ একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। প্রতিশোধ পরায়ণ এই গ্রুপগুলো একের পর এক রক্তপাতসহ নানা অপকর্ম  করছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও জুড়া সাব মাঝি  হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পজুড়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর অনুসারীরা এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা সাধারণ রোহিঙ্গাদের। তাদের দাবি, মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংগঠনটি বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই সংগঠন রোহিঙ্গাদের সব সময় শান্তির পথ দেখাতো। এ কারণে সাধারণ শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। আর এ কারণেই প্রত্যাবাসন বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর টার্গেটে পরিণত হন মুহিবুল্লাহ। প্রত্যাবাসন বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতেই  রোহিঙ্গাদের এই শীর্ষ নেতা খুন হন বলে ধারণা সাধারণ রোহিঙ্গাদের।

মাস্টার মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ছিলেন। শুধু তাই নই আরসা নেতার বিরুদ্ধে সাক্ষী হওয়ায় টার্গেট ছিল দুই সাব মাঝি মিয়ানমারভিত্তিক উগ্রপন্থি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নেতা মো. সলিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাদক মামলার সাক্ষী হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবার জোড়া খুনের ঘটনা ঘটল।

১০আগসাট রাত পৌনে ১২টার দিকে উখিয়ার জামতলী এলাকার ক্যাম্প—১৫—এর সি—৯ ব্লকের দুর্গম পাহাড়ের ঢালে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন ক্যাম্প—১৫—এর ব্লক সি/১—এর আবদুর রহিমের ছেলে প্রধান মাঝি আবু তালেব (৪০) ও একই ক্যাম্পের সি/৯—এর ইমাম হোসেনের ছেলে সাব—ব্লক মাঝি সৈয়দ হোসেন (৩৫)। ক্যাম্পে যাঁরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভালো—মন্দ দেখভাল করেন, তাঁদের মাঝি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, চলতি বছরের ৭ এপ্রিল আরসা নেতা সলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে করা মাদক মামলার সাক্ষী ছিলেন তালেব। ওই মামলার সাক্ষী হওয়ায় তালেব ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোসেনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সলিম ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ। এ ছাড়া তালেব ও হোসেনকে গুলি করার পর প্রথমে ক্যাম্পে একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে তাঁদের নেওয়া হয়। জীবন—মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার সময় তাঁরা জবানবন্দি দিয়েছেন। আইনের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডায়িং ডিক্লারেশন’। তালেব তাঁর নূর বশার ও আরেক মাঝি সাব্বিরের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। সেখানে উঠে আসে, ওই হত্যা মিশনে ১০—১২ জন ছিল। এতে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন সলিমের ভাই মাহমুদুল ও জাহিদ। তাঁদের দু’জনের সঙ্গে আরসার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হিসেবে মাহমুদুল ও জাহিদ অনেক দিন ধরেই তালিকাভুক্ত। একটি দায়িত্বশীল সূত্র  জানায়, মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে তালেব জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছিয়া বেগমের বাড়ির সামনে বাঁশের তৈরি মাচার ওপর প্রায় প্রতিদিন রাতে গল্প করতেন দুই বন্ধু তালেব ও হোসেন। প্রতিদিনের মতো গেল ১০ আগস্ট  তাঁরা আলো—আঁধারি পরিবেশে বসে গল্প করেন। হঠাৎ একদল সশস্ত্র যুবক এসে তাঁদের এলোপাতাড়ি গুলি করে। ওই দলের অনেক সদস্য মুখোশ পরিহিত ছিল। হত্যা মিশন শেষ করেই পাহাড়ি পথ ধরে তারা পালিয়ে যায়।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই সলিমের বাহিনীর ক্যাম্প ঘিরে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। কারাগারে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গীরা শুরু করে গোপন তৎপরতা। সলিম ছাড়াও নবী হোসেন ও মাওলানা আজিজ নামের আরও দুই আরসার নেতার জোড়া হত্যার সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

এ ছাড়াও প্রত্যেক ক্যাম্পজুড়ে রয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সশস্ত্র বিচরণ। ওই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোরই কেউ মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে বলে ধারণা পুলিশের। ইতোমধ্যে এ হত্যাকাণ্টের ঘটনায় জড়িতদের কয়েকজনের নামসহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিহত মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বলেছেন, আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে আমি যাদের দেখেছি তারা হলেন— মাস্টার আব্দুর রহিম, মোরশেদ, নাগো, আরেকজন কালো করে মাথায় লম্বা চুল। সর্বমোট ২০ থেকে ২১ জন লোক এসেছিল। সবার হাতে অস্ত্র ছিল।

মুহিবুল্লাহর ভাইয়ের বর্ণনা থেকেও বোঝা যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কতটা বেপারোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা।

পুলিশের তথ্য মতে, ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত চার বছরে ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৩৪ জন নিহত হয়েছেন। ২ হাজার ৮৫০ জনের বিরুদ্ধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই হয়েছে মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে। আর এ সময়ের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৯৯টি।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে একটি মাদ্রাসার ছয়জন ছাত্র—শিক্ষককে একসাথে হত্যার ঘটনা সবাইকে বিচলিত করে। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা, আতঙ্কে অনেকেই রাতে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

বর্তমানে রোহিঙ্গারাই তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এপিবিএন পুলিশের সাথে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছেন। সর্বশেষ ১০ আগস্ট মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২ টার দিকে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে উখিয়া জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুর্গম পাহাড়ের ঢালে। র‌্যাব—পুলিশের তথ্য বলছে, এসব বাহিনীর অর্থের বড় একটি উৎস ইয়াবা, মানব পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালান। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যেসব সিন্ডিকেট ইয়াবা, মানব পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালান করছে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয় তারা। এমনকি সাগরপথে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের শুরুতে এই পাহাড়ে রাখা হয়।

ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোঃ কামরান হোসেন ভিশন নিউজ ২৪কে জানান, একটি দুষ্কৃতিকারী রোহিঙ্গা গ্রুপের সদস্যররা দল বেঁধে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হেড মাঝি আবু তালেব ও সাব ব্লক মাঝি ছৈয়দ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পে ব্লক রেইড এবং অভিযান চলছে। এখনো সক্রিয় ১৫টি অপরাধী দল।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম ভিশন নিউজ ২৪ কে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুনির্দিষ্ট কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন আছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে মাঝেমধ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। সেখানে পুলিশ, এপিবিএনসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের বিষয়ে তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা দুই রোহিঙ্গা মাঝিকে কে বা কারা হত্যা করেছে তা তদন্ত শেষ না হলে বলা সম্ভব নয়। আর জঙ্গি তৎপরতা যাতে না হয় সে বিষয়েও প্রশাসনের কঠোর নজরদারি রয়েছে।

কক্সবাজারের এপিবিএন—১৪ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আনোয়ার ভিশন নিউজ ২৪কে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন সংগঠনের নাম শোনা গেলেও তেমন সক্রিয় গ্রুপ নেই। দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে যে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো নিজেদের জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.