The news is by your side.

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে অস্বস্তিতে মানুষ

0 170

এক বছরের ব্যবধানে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, ডিম, মাছ, মাংস, চিনি, মসলাসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। কিছু কিছু পণ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে সাধারণ মানুষের আয় তেমনভাবে বাড়েনি। ফলে আয়ের সঙ্গে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছে না বেশির ভাগ মানুষ।

বিদায়ি বছরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির রেকর্ড ছিল। এতে খাদ্যতালিকা কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।

সরকার গঠনের পরই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে দেশে উৎপাদিত পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য মূলত বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বরত বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর জোরালো ভূমিকা না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরা নানা অজুহাতে যখন তখন পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছেন।

বিশেষ করে স্বল্প আয়ের এবং মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ছে, তা আর কমছে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ক্রমেই তা ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি কমাতে এবং নিত্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হলে সরকারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ও অর্থনীতিবিদরা।

গতকাল রবিবার রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে কথা হয় আবুল খায়ের নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি রামপুরা এলাকায় হার্ডওয়্যারের দোকানের বিক্রয় কর্মী।

তিনি বলেন, ‘২৬ হাজার টাকা মাসিক বেতন পাই, এক রুমের বাসায় স্ত্রী ও চার বছরের এক ছেলেকে নিয়ে থাকি। ভাড়া দিতে হয় আট হাজার টাকা, সঙ্গে রান্নার জন্য এলপি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল নিয়ে ১০ হাজার টাকা খরচ পড়ে। আগে মাসে ৮-১০ হাজার টাকায় খাবার খরচ হয়ে যেত। এখন ১৫ হাজার টাকা দিয়েও ঠিকমতো সংসার চালানো যাচ্ছে না। ব্যয় সামাল দিতে না পেরে অনেক পছন্দের খাবারও বাদ দেওয়া হয়েছে। তার পরও প্রতি মাসেই দোকান থেকে বাকিতে পণ্য কিনতে হয়। খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে এখন আমাদের চলতে হচ্ছে। সামনে পণ্যের দাম না কমলে পরিবার নিয়ে নিজ বাড়ি নাটোর চলে যেতে হবে।’

২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে হঠাৎ পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। প্রথমবারের মতো ভারত থেকে আলু ও ডিম আমদানিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা ও দেশি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা এবং ফার্মের ডিমের ডজন বেঁধে দেওয়া হয় ১৪৪ টাকায়। যদিও নির্ধারিত দরের চেয়ে এখনো উচ্চমূল্যেই আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে বছরের শেষ দিক থেকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কিছুটা কমে ডিম কিনতে পারছেন ক্রেতারা। সব মিলিয়ে দেশের মানুষকে গত বছরজুড়ে ভুগিয়েছে নিত্যপণ্যের উচ্চ দর। নতুন বছরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের অদক্ষতা রয়েছে। যার ফলে নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বাজারটি সরকার নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল, কিন্তু সেটি চলে গেছে সিন্ডিকেটের দখলে। যার কারণে কোনো ধরনের অজুহাত ছাড়াই প্রায় সময়ই বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তাই বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তা না হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।’

গত বছরের জানুয়ারি মাসের বাজারদরের সঙ্গে গতকালের বিভিন্ন খুচরা বাজার এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে মোটা চাল ব্রি-২৮ কেজিতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে। ৩ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে সরু বা চিকন চাল। তবে এক বছরের ব্যবধানে খোলা আটার দাম কেজিতে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ এবং ভোজ্য তেল বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনির দাম কেজিতে ২৬ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ৬০ থেকে ৬৭ শতাংশ দাম বেড়ে আলু বিক্রি হচ্ছে। ৩৫ থেকে ৪০ টাকার দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ১২৫ থেকে ১২৯ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়ে রেকর্ড করেছে দেশি রসুন। কেজিতে ২৩৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে দেশি রসুন। আমদানি করা রসুন ১০০ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৬০ টাকায়।

জানতে চাইলে আমদানিকারক ও পাইকারি শ্যামবাজারের পেঁয়াজ-রসুন ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশি রসুনের সরবরাহ সংকট থাকায় এবং চীনে রসুনের বাড়তি দামের কারণে এখন বাজারে দাম বাড়তি। আগামী মাসের শুরুতেই বাজারে দেশি নতুন রসুন চলে আসবে। তখন দাম অর্ধেকেরও নিচে নেমে যাবে। পেঁয়াজের দাম এখন অনেক কমে গেছে, আগামী ছয় মাস পেঁয়াজ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।’

আব্দুল মাজেদ জানান, শ্যামবাজারে গতকাল পাইকারিতে দেশি রসুন কেজি ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা এবং আমদানি করা রসুন কেজি ২০৫ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হয়। নতুন রসুন বাজারে চলে এলে দেশি রসুনের কেজি ১০০ টাকায় চলে আসবে বলেও তিনি জানান।

গত বছর চালের বাজারে তেমন কোনো অস্থিরতা ছিল না। তবে জাতীয় নির্বাচনের পরপরই চালের দাম হুট করেই বস্তাপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার পর গত মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে মজুদবিরোধী অভিযান শুরু করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। নিয়মিত অভিযানের কারণে পাইকারি পর্যায়ে কিছুটা দাম কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, বস্তায় ৩০০ টাকা বাড়লেও অভিযানের কারণে কমেছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

জানতে চাইলে বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার আমন মৌসুমে বাড়তি দামে ধান কিনতে হয়েছে মিলারদের। যার কারণে তাঁরা চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। মিলাররা ও বড় করপোরেট কম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে বাড়তি দামে ধান কিনেছিল, যার প্রভাব এরই মধ্যে বাজারে পড়েছে। তবে নিয়মিত অভিযানের কারণে পাইকারিতে আবার দাম কিছুটা কমেছে।’

রাজধানীর বাড্ডার খুচরা ও পাইকারি মুদি ব্যবসায়ী মো. শহিদুল হক বলেন, ‘গত এক বছরের ব্যবধানে চালের দামে তেমন পার্থক্য না থাকলেও গত দুই সপ্তাহে সব ধরনের চাল কেজিতে চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। দাম বেড়ে খুচরায় মোটা চাল ব্রি-২৮ কেজি ৫৬ থেকে ৬০ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) মানভেদে কেজিপ্রতি ৭২ থেকে ৮০ টাকা ও নাজিরশাইল মানভেদে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।’

এখন চলছে শীতের ভরা মৌসুম। বাজারেও নানা পদের শাক-সবজির সরবরাহ রয়েছে। এই সময় দামও তুলনামূলক কম থাকার কথা। কিন্তু এ বছর বাজারে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। সব ধরনের শাক-সবজি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে মুলা ও পেঁপে ছাড়া ৫০ টাকার নিচে সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। ভরা মৌসুমেও ক্রেতাদের ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বেগুন ও শিম কিনতে হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপিও ৫০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। যদিও গত শীতের মৌসুমে এসব পণ্য বর্তমানের দামের চেয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি হয়েছিল।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.