সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে তানভীর ও জেসমিনকে ৫ কোটি টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দণ্ডবিধির ৪২০ ধারার অধীনে ৭ বছর কারাদণ্ডের সঙ্গে ২৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম মঙ্গলবার এ রায় দেন।
আদালত রায়ে বলেছেন, এ মামলার ঘটনা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক বিষ্ময়কর ঘটনা। যে অপরাধিরা দেশের, জনগণের আমানত, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলা মনে করে, তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ অবস্থায় অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের যাবজ্জীবন কারদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।
যাবজ্জীবন পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন- সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখার সাবেক সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, হল-মার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিযা, প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল রাজা, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান।
দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই সাত আসামিকেও দণ্ডবিধির ৪২০ ও ১০৯ ধারার অধীনে ৭ বছরের কারাদণ্ডের সঙ্গে প্রত্যেককে দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।
এ ছাড়া দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অধীনে সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সফিউদ্দিন আহম্মেদ, মো. কামরুল হাসান খান ও সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সঙ্গে ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪২০ ও ১০৯ ধারার অধীনে তাদের প্রত্যেককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আসামি মো. জামাল উদ্দিন সরকারকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অধীনে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সঙ্গে ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪২০ ও ১০৯ ধারার অধীনে তাকে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে জামাল উদ্দিন ও আলতাফ হোসেন জামিনে রয়েছেন। আর পলাতক রয়েছেন সাইফুল ইসলাম, আবদুল মতিন, হুমায়ুন কবির, গোপাল নাথ, তসলিম, সাইফুল হাসান, মেহেরুন্নেসা ও জাকারিয়া। কারাগারে আছেন তানভীর, তুষার, জেসমিনসহ অপর আটজন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, তানভীর ও জেসমিনসহ সব আসামিকে দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় সাজা ও অর্থ দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সব সাজা একসঙ্গে চলবে। অর্থাৎ যে আসামিদের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে, অন্যকোনো ধারায় তারা অন্য কোনো মেয়াদের সাজা দেওয়া হলেও তাদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাভোগ করতে হবে। অন্য আসামিদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। যে সাত আসামিকে এক ধারায় ১০ বছর এবং আরেক ধারায় ৭ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাদের ১০ বছর কারাভোগ করতে হবে। তবে অর্থদণ্ড বা জরিমানার ক্ষেত্রে তা হবে না। অর্থদণ্ড আলাদাভাবেই গণ্য হবে। অর্থাৎ তানভীর-জেসমিনকে ৫ কোটি টাকার সঙ্গে ২৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডও দিতে দিতে হবে। অন্য দণ্ডিতদের ক্ষেত্রেও তাই।
এক যুগ আগে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় হল-মার্ক গ্রুপের মালিক, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। রায় হওয়া মামলাটি তারই একটি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু সেদিন দুদকের পক্ষ থেকে আরো দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে ওই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য নেন আদালত। অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় এ মামলা করে দুদক।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে হল-মার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে দায় (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা।
তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১ মামলায় হল-মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর, তার ভায়রা তুষারসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত ২০১৬ সালে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ১১টি মামলা বিচারের জন্য পরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ বদলি করা হয়।