The news is by your side.

সিন্ডিকেটের দাপুটে উত্থান, অসহায় ভোক্তারা

0 81

 

দেশে নিত্যপণ্যের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহব্যবস্থাও স্বাভাবিক। এরপরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। পাশাপাশি সব ধরনের সেবার মূল্যও বাড়ছে বেপরোয়া গতিতে। এতে ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে লাগামহীনভাবে। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমে যাচ্ছে।

ফলে জীবনযাত্রার খরচ যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। এতে সংসার চালাতে মানুষ ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। ভোক্তার পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। বাজারে গিয়ে মানুষ ক্ষোভ ঝাড়ছেন সরকারের বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে একটি চক্র। তারা প্রতিবছর ভোক্তাকে জিম্মি করে হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ওই চক্রের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। এভাবেই নির্বিঘ্নে দাপুটে উত্থান ঘটছে বাজার সিন্ডিকেটের।

সরকারি দু-একটি সংস্থা কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নামমাত্র জরিমানা করছে। এতে জরিমানার অর্থ তুলতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সিন্ডিকেটর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে জোর দাবি উঠেছে। কিন্তু সরকারের একাধিক মন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে-ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট কি বেশি শক্তিশালী?

২০২০ সালে করোনার সময় সরবরাহ সংকট দেখিয়ে পণ্যের দাম একদফা বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ে। এতে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সৃষ্টি হয় ডলার সংকট। বেড়ে যায় ডলারের দাম। এর প্রভাবে বাড়তে থাকে পণ্যের দামও। যতটুকু না আন্তর্জাতিক বাজার বা ডলারের দামের প্রভাব পড়েছে, এর চেয়ে বেশি বেড়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে।

সবজির দামের সঙ্গে ডলার ও আন্তর্জাতিক বাজার খুব বেশি সম্পৃক্ত নয়। কেবল জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহণ ভাড়া ও কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে এতে। কিন্তু গত এক বছরে সবজির দাম বেড়েছে বেপরোয়া গতিতে। বর্তমানে ৮০ টাকার নিচে সবজি মিলছে না বললেই চলে।

চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, পেঁয়াজ-রসুন, মাছ-মাংসসহ সব পণ্যের ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। গত দুই বছরের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চিনি ৬৮ ও আদা ২৬০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। রুইমাছের কেজি ছিল ১৮০, এখন তা বেড়ে ৪০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পাবদামাছ ছিল ২৫০ টাকা কেজি। এখন তা ৫০০ টাকা।

শিল্পপণ্যের দামও বাড়ছে আকাশছোঁয়া গতিতে। চার প্যাকেটের নুডলসের দাম ছিল ৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৯৫ টাকা হয়েছে। ৩৫ টাকার সাবান এখন ৬৫ টাকা, ৬০ টাকা দামের চানাচুরের প্যাকেট এখন ৯০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ডলার, কাঁচামাল ও পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম এত বাড়ার কথা নয়। সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণেই এগুলোর দাম বেশি মাত্রায় বেড়েছে। করোনার আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। করোনার পর তা প্রকট আকার ধারণ করে। চলতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।

এর প্রভাবে একদিকে মানুষের আয় কমেছে, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বাড়ায় ব্যয় বেড়েছে লাগামহীনভাবে। গত বছরের আগস্টের তুলনায় গত আগস্টে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে বেশি বাড়ছে। একই সঙ্গে খাদ্যপণ্যে এ হার আরও বেশি। ওই সময়ে গ্রামে বেড়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। খাদ্য খাতে এ হার ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। আগস্টে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। মানুষের আয়-ব্যয়ে ঘাটতি বেড়েছে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ। এ অর্থ মানুষ ঋণ করে ব্যয় মেটাচ্ছে।

ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে সরকার থেকে বাজারের ওপর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু তা সুফল বয়ে আনছে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের নজরদারিকে তোয়াক্কা না করেই কথিত সিন্ডিকেট পণ্যের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। তারা একসময় একেক পণ্যকে টার্গেট করে দাম বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে পান-সুপারি থেকে শুরু করে চাল-ডাল, পেঁয়াজ কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে-ভোক্তা বাজারে পণ্যে হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে তারা চাহিদা কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। এত কিছুর পরও ক্রেতাকে সুরক্ষা না দিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। ফলে ভোক্তাদের মাঝে একধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

শুক্রবার রাজধানীর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক ছায়া সংসদে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডিমের দাম বৃদ্ধি বিষয়ে বলেন, আমরা সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিলাম, তারা (সিন্ডিকেট চক্র) বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। তখন ভোক্তারা পণ্য পেল না। এজন্য আমাদের সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়। এর আগেও বাণিজ্যমন্ত্রী নিত্যপণ্য নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দেবে। তখন ভোক্তা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

১১ মে অর্থনৈতিক সাংবাদিক সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম বা ইআরএফ ও এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদার বলেছেন, ‘আমাদের কিন্তু কোনো কিছুর অভাব নেই, আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশে এ অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থনীতি ও বাজার-এ দুই জায়গায়ই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যে কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি লুটপাট করে বড়লোক হচ্ছেন, তাকে আরও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে কিছু ব্যক্তির কাছে ব্যাংক থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজার ও সিন্ডিকেট সম্পর্কে মন্ত্রী পর্যায়ে এ ধরনের কথায় সাধারণ জনগণ হতাশ হয়ে যান। অন্যদিকে যারা সিন্ডিকেট করেন তারা আরও উৎসাহবোধ করেন। তারা ভাবেন আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের চোখের জল ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী যদি সিন্ডিকেটে হাত দিতে না পারেন, তাহলে যে কাজটি করতে পারেন সেটি হলো-যারা সিন্ডিকেট করেন, তাদের তো সরকার চেনে ও জানে। কাজেই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে সরকারি যেসব নীতিসহায়তা আছে, সেগুলো কমিয়ে দিতে পারেন।

এক্ষেত্রে সরকার বলতে পারে-তোমরা যদি সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াও, তাহলে এসব সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হবে। যেমন সস্তা ঋণ, ভর্তুকি, প্রণোদনা, কর অব্যাহতিসহ সরকারি সেসব সুবিধা তারা পায়, সেগুলোয় সরকার হাত দিতে পারে। তাদের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিতে পারে। এতে কথিত সিন্ডিকেটের লোকজন সামাজিকভাবে হেয় হবে।

সূত্র জানায়, পণ্যমূল্য নিয়ে কারসাজি করলে অসাধুদের ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সরকারের একাধিক সংস্থা কাজ করছে। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সবকিছুর তদারকি করছে। এছাড়া পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা, সিটি করপোরেশন, মাঠ প্রশাসন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কাজ করছে। তারপরও গুটিকয়েক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না কেন? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ওই অঞ্চলের কয়েকজন পেঁয়াজ সিন্ডিকেট শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি তালিকা পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেই চিহ্নিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে পেঁয়াজের দামও কমেনি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.