The news is by your side.

সহজে বিশ্বাস করা যাবে না দুর্ধর্ষ কেএনএফকে , বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা

0 58

বান্দরবানের থানচি ও রুমায় ব্যাংকে দুর্ধর্ষ ডাকাতি ও থানায় হামলার পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে হামলা করছে। আগের তুলনায় ৩-৪ গুণ সদস্য বাড়িয়ে এখন আরও দুর্ধর্ষ কেএনএফ। তাদের সক্রিয় নারী সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতি ও থানচি থানা হামলায় সরাসরি অংশ নেয়। সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণের পর কেএনএফ গহিন পাহাড়ে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে যায়। র‍্যাবের মধ্যস্থতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে উদ্ধার করা হয়। এতকিছুর পর কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আলোচনার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দুর্ধর্ষ কেএনএফকে সহজে বিশ্বাস করা যাবে না।

দুর্ধর্ষ কেএনএফের তৎপরতা থামাতে এরইমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে পুলিশ-র‌্যাব-সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সংগঠনটির সশস্ত্র শাখাকে চিহ্নিত করার জন্য একাধিক টিম গঠন করেছে পুলিশ।

সশস্ত্র এই বাহিনীর বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, কেএনএফ একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের খুব সহজে বিশ্বাস করা যাবে না। সংগঠনটির সঙ্গে শান্তি আলোচনা বৈঠকে যারা জড়িত রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কৌশল সম্পর্কে তারা অভিজ্ঞ কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। আবার ভূরাজনীতির কৌশলগত কারণে কেএনএফকে কেউ ব্যবহার করেছে কিনা তা বের করা জরুরি। তবে পার্বত্য এলাকায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সক্ষমতা রয়েছে তার সিকিভাগও কেএনএফের নেই। এর আগে তাদের চেয়ে দুর্ধর্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করেছি আমরা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, কেএনএফের ভেতরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে যারা রয়েছে, তাদের ভেতর থেকে কোনো গ্রুপ বেকায়দায় ফেলতে পারে। তারা হয়তো ভাবতে পারে, শান্তির পথে চলে গেলে সংগঠনের গুরুত্ব কমে যাবে। তবে এই হামলার বড় প্রভাব থাকবে।

তিনি বলেন, কেএনএফের প্রভাবাধীন এলাকায় শান্তি অনিশ্চিত হয়ে গেল। এ ছাড়া তাদের সঙ্গে পাহাড়ের অন্য কোনো বড় সশস্ত্র গ্রুপের নতুন যোগাযোগ তৈরি হয়েছে কিনা, তাও দেখতে হবে।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, বান্দরবানে যতগুলো অপরাধ কেএনএফ করেছে, পর্যায়ক্রমে সবগুলোর ক্ষেত্রেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেশ কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা অপরাধ ঘটাচ্ছে বলে তথ্য আমরা পেয়েছি। কেউ ছাড় পাবে না।

গোপন আস্তানা

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে কেএনএফের সুরক্ষিত কিছু আস্তানা রয়েছে। ব্যাংক ম্যানেজার নেজামকে এ ধরনের একাধিক আস্তানায় রাখা হয়েছিল। অপহরণের পর তাঁকে কোনো মারধর করা হয়নি। পাহাড়ের মধ্যে অস্ত্রধারীরা তাঁকে ঘিরে ছিল। হঠাৎ হঠাৎ ওই আস্তানায় খাবার আসত।ম্যানেজার যেখানে ছিলেন, সেখানে পাহারায় নিয়োজিত কয়েকজন বাংলা ভালোভাবে বুঝতে পারে না। সশস্ত্র পাহারায় কখনও পাহাড়ি ও ঝিরির পথ ধরে ও মোটরসাইকেলে এক আস্তানা থেকে আরেক আস্তানায় নেওয়া হতো নেজামকে। মঙ্গলবার অস্ত্রের মুখে ধরে নেওয়ার পর চোখ বেঁধে বেথেলপাড়ার পাশ দিয়ে ঝিরির পথে নেওয়া হয়। কিছু দূর নিয়ে চোখ খুলে দিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা হাঁটানোর পর একটি নির্জন এলাকায় ঘুমাতে দেওয়া হয়।

বুধবার সকালে নেওয়া হয় আরেক ঝিরিতে। সেখানে কলাপাতায় মোড়ানো ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি খেতে দেওয়া হয়। পরে আবার হাঁটিয়ে আরেক জায়গায় নেওয়া হয়। মাঝে নেজামকে ১০-১৫ মিনিট বিশ্রাম করার সুযোগ দেয় অস্ত্রধারীরা। বুধবার রাতে তাঁকে একটি মাচাং ঘরে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে ঘুমাতে দেওয়া হয়।

এরপর নেজামকে পরিবারের সদস্যদের ফোনে কথা বলার সুযোগ দেয় অস্ত্রধারীরা। উদ্ধারে যাতে পরিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না নেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। ফোনকলের সূত্র ধরেই নেজামের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পায় র‌্যাব। কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপের নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, কেএনএর হাতে অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে।

নিস্ফল শান্তি আলোচনা

গত বছরের জুলাইয়ে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। দু’দফা ভার্চুয়াল আলোচনার পর ৫ নভেম্বর প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল রুমার মুনলাই পাড়ায়। এর পর ৫ মার্চ বান্দরবানের রুমা উপজেলার বেথেল পাড়ায় দ্বিতীয় দফায় মুখোমুখি বৈঠক হয়েছে। ২২ এপ্রিল তৃতীয় দফায় সশরীরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে তা বাতিল করে দেয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।

কমিটির অন্যতম সদস্য জারলম বম বলেন, কেএনএফের সর্বশেষ অপকর্মের পর শান্তি আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, ব্যাংক ডাকাতি এবং ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় কেএনএফের সঙ্গে সংলাপ করার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

পাহাড়ে যত গ্রুপ

স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গত শতকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হওয়ার পর পাহাড়ে স্বস্তি ফিরে আসে। তবে সেই সুবাতাস বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পাহাড়ে ছোট ছোট কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়।

চুক্তির পর চুক্তিবিরোধীরা পাহাড়ি তরুণদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত এখনও চলছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালে জেএসএসের একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে জেএসএস (লারমা) নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) নামে একটি দল গড়ে ওঠে বান্দরবানের আলীকদমে।

২০১৫ সালের নভেম্বরে দলটির ৭৯ জন সদস্য একযোগে আত্মসমর্পণ করেন। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০১৮ সালে বান্দরবানে ‘মগ পার্টি’ তৎপরতার তথ্য সামনে আসে।

কেএনএফ যা বলছে

গতকাল কেএনএফ তাদের ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়। সেখানে তারা দাবি করে, অপারেশন চলাকালে কোনো নিরীহ বাঙালিকে অহেতুক অপহরণ করেনি তারা। অপহরণ করা হলেও প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর মুক্ত করা হয়। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যাংক ম্যানেজার। এখন পর্যন্ত কোনো বাঙালি বন্দি অবস্থায় কেএনএফ ক্যাম্পে নেই। আর কেএনএফ এখন পর্যন্ত নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেনি।

কেএনএফ দাবি করেছে, শান্তি আলোচনায় স্বাক্ষরিত সমঝোতা শর্তসমূহ লঙ্ঘন করা হয়েছে।   শর্ত মোতাবেক ক্ষতিগ্রস্ত কুকি–চিন জনগোষ্ঠীকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি। শান্তি আলোচনাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ করেছে কেএনএফ। তবে শান্তি আলোচনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সদস্য সমকালকে বলেছেন, কেএনএফ যেসব দাবি করেছে তা সঠিক নয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.