The news is by your side.

মুজিবনগর সরকারের শপথ: মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘোরানো ঘটনাবলি

0 491

 

 

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হলেও তৎকালীন পরিস্থিতিতে ওই সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল। মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে হয়েছিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সেই সরকারে পাকিস্তানে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি। তার নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর’। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কৌশল নির্ধারণ ও পরিচালনার প্রধান পুরুষ হয়ে ওঠেন। সরকার গঠনের পরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অত্যাবশ্যক সাংগঠনিক কাজগুলো গতিবেগ পায়। কাজেই এটা ছিল ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও অন্যতম প্রধান মোড়-ঘোরানো ঘটনা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই প্রথম সরকার ঐতিহাসিকভাবে পরিচিতি পায় ‘মুজিবনগর সরকার’. নামে। অস্থায়ী সরকার ও প্রবাসী সরকারও বলা হয়। মুজিবনগর বাংলার অস্থায়ী রাজধানীরও স্বীকৃতি পেয়েছিল। শপথ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৯৭০-৭১-এর নির্বাচনে জয়ী উপস্থিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত আইন পরিষদের অনুমোদিত ঘোষণাপত্র সার্বভৌম বাংলাদেশের আইনগত ভিত্তি তৈরি করে। মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর অল্প সময়ে মুজিবনগরে ছিল, পরে ভারতের কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

ইতিহাসে দেশে দেশে স্বাধীনতাকামী ও বিপ্লবীদের প্রবাসে এ ধরনের সরকার গঠনের নজির আছে অনেক। পোল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী প্রবাসী সরকারের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছিল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে। প্রিন্স নরোদম সিহানুকের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন কম্বোডিয়ান সরকারের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছিল চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে। তবে এসব সরকারের তুলনায় মুজিবনগর সরকার ছিল অনেকটাই অতুলনীয়। কারণ, স্বাধীন অঞ্চলে নেতৃত্ব, দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনসমর্থন ও সহানুভূতি, নিজস্ব আয়-ব্যয়ের ব্যবস্থা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা, এক কোটি শরণার্থীর ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জনগণের নজিরবিহীন সমর্থন ও ত্যাগ স্বীকার, পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে এই সরকার তার সামর্থ্যকে প্রমাণ করেছিল মাত্র সাড়ে ৯ মাসের মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টার পর। আশপাশের কয়েকটি বাড়ি থেকে কিছু চেয়ার-টেবিল সংগ্রহ করে সেখানে আনা হয়। ঘন বাগানের মধ্যেই একটু ফাঁকা জায়গায় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা হয় ছোট্ট একটি মঞ্চ। মঞ্চে একটি চেয়ার খালি রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। আইন পরিষদ বা গণপরিষদের স্পিকার হিসেবে অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। অন্য সদস্য আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রীদের পরিচয় করিয়ে দেন। ভাষণ দেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। অস্থায়ী সরকার গঠনের পটভূমি নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন আমীর-উল ইসলাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

তখন মুজিবনগর সরকারের কাঠোমো ছিল রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানে বন্দি), উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকারবলে সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ), প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যিনি প্রতিরক্ষা, তথ্য সম্প্রচারসহ অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বে থাকেন। অর্থ ও শিল্প বাণিজ্যমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান এবং পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। প্রধান সেনাপতি হয়েছিলেন কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী এমএনএ এবং চিফ অব স্টাফ কর্নেল (অব.) আবদুর রব, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও বিমানবহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার।

অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত হলেও দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক এবং কিছু আমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তবে শপথ অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিল। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে তখনকার ১০৭টি দেশের সরকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের সংগঠক ও সমন্বয়ক ছিলেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি মেহেরপুরের মহকুমা কর্মকর্তার (এসডিও) পদ থেকে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি বীরবিক্রম খেতাবেও ভূষিত হয়েছেন। মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় শপথ অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশ হয়ে গেলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী সেখানে বোমা বর্ষণ করে। তাই মেহেরপুরে শপথ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে। এমন একটি জায়গা বাছাই করা হয়েছিল, যেখানে ভারত থেকে সহজেই ঢোকা যায় এবং ওই এলাকা পাকিস্তান বাহিনীর বিমান আক্রমণ থেকেও যাতে নিরাপদ থাকে। সেজন্য আম্রকাননটি বেছে নেওয়া হয়েছিল।’
অস্থায়ী সরকারকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সরকারের ভেতরে কিছু উপদল ও মতপার্থক্য তৈরি হয়। কয়েকজন ছিলেন তাজউদ্দীনের সরকার গঠন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসেও তার ভূমিকা ছিল অস্বচ্ছ। আমেরিকার সিআইএর সঙ্গে গোপন যোগসাজশে তিনি স্বাধীনতার পরিবর্তে পাকিস্তান কনফেডারেশনের পক্ষে চক্রান্তে যুক্ত ছিলেন বলে সন্দেহ রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার নায়ক হিসেবে তিনি নিজেকে চূড়ান্তভাবে ‘মীরজাফর’ রূপে প্রতিভাত করেন।

শপথ অনুষ্ঠানের পরের দিন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুজিবনগর সরকার। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধকে সর্বজনীন করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ’। সদস্যরা সবাই ইতোমধ্যে মারা গেছেন। তারা হলেন- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সিপিবির সভাপতি মণি সিংহ, ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মনোরঞ্জন ধর। এ ছাড়াও পদাধিকারবলে ওই পরিষদে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মোশতাক আহমদ।

মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই নতুন বেগে এগিয়ে যায়, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর বাণী :মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাণী দিয়েছেন। পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তারা।

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ মুজিবনগর দিবসে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গঠনে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই সরকার গঠনের ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। জনমত সৃষ্টি, শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা ও যুদ্ধের রণকৌশল নির্ধারণে মুজিবনগর সরকার যে ভূমিকা পালন করেছে, তা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবগাথার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, মুজিবনগর দিবসের ৫০ বছর পূর্তিতে আমার আহ্বান- সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে হলেও ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে হবে। জাতির পিতা যে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সব আশু ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখব, ইনশাআল্লাহ।
মুজিবনগরে প্রতি বছর জাতীয় কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে মুজিবনগর দিবস পালিত হলেও এবার করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সেখানে সীমিত কর্মসূচির আয়োজন করা হবে।

 

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.