The news is by your side.

বরিশালে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

কতটা  প্রস্তুত স্বাস্থ্য বিভাগ?

0 1,204

 

 

বরিশাল অফিস

এক সপ্তাহের ব্যবধানে বরিশালে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে ২০ শতাংশ। প্রতিদিনই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। করোনা উপসর্গ রয়েছে, এমন বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে আসার পূর্বে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে।

গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে নতুন করে ৪১৪ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।  আগের দিন ২৪ ঘণ্টায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২২। সর্বশেষ আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে বিভাগে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০হাজার ৫২৮ জন।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস জানান, মোট আক্রান্ত ২০ হাজার ৫৬৮ জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ হাজার ৫৫৫ জন।

আক্রান্ত সংখ্যায় বরিশাল জেলায় নতুন ১২৫ জন নিয়ে মোট ৮ হাজার ৮২৮ জন,পটুয়াখালী জেলায় নতুন ৩৯ জন নিয়ে মোট ২৭১৮ জন, ভোলা জেলায় নতুন ৩৪ জন সহ মোট ২১৮১ জন,পিরোজপুর জেলায় নতুন ৬১ জন নিয়ে মোট ২৭৬৫ জন, বরগুনা জেলায় নতুন ৬২ জন নিয়ে মোট আক্রান্ত ১৭০৯ জন এবং ঝালকাঠি জেলায় নতুন ৯৩ জন শনাক্ত নিয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩৬৭ জন।

এদিকে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র বরিশাল শেবাচিম হাসাপাতালের করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ডে উপসর্গ নিয়ে এগারজনের মৃত্যু হয়েছে। যা নিয়ে শুধুমাত্র শেবাচিম হাসপাতালেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২১৮ জন এবং আইসোলেশন ওয়ার্ডে উপসর্গ নিয়ে ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করা ৫৭৮ জনের মধ্যে ৪৬ জনের কোভিড টেস্টের রিপোর্ট এখনো হাতে পাওয়া যায়নি।

হাসপাতাল পরিচালক কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহষ্পতিবার) সকাল পর্যন্ত শেবাচিমের করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৩৩ জন ও করোনা ওয়ার্ডে ১২ জন ভর্তি হয়েছেন। করোনা ও আইসোলেশন ওয়ার্ডে এখন ২১৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন। যাদের মধ্যে ৫৭ জনের করোনা পজিটিভ এবং ১৬০ জন আইসোলেশনে রয়েছেন। আরটি পিসিআর ল্যাবে মোট ১৮৯ জন করোনা পরীক্ষা করান। যারমধ্যে ৫১.৮৫ শতাংশ পজিটিভ শনাক্তের হার।

৮০ লাখ মানুষের বিপরীতে একটি করোনা ওয়ার্ড

বরিশাল বিভাগ তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে করোনা রোগীদের চিকিৎসার একমাত্র ঠিকানা-বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটিমাত্র করোনা ওয়ার্ড। ওয়ার্ডের আইসোলেশন  বেড সংখ্যা ৩০০। আইসিইউ আছে ২২টি। করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য রয়েছে একটি আরটি পিপিআর ল্যাব। রয়েছে অক্সিজেন সংরক্ষণ ব্যবস্থা।

বিভাগের আওতাধীন ৬ টি জেলার সবগুলো উপজেলা থেকে করোনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য মানুষ এখানে আসায় কোন ভাবেই রোগীর চাপ সামাল দিতে পারছে না শেবাচিমের একমাত্র করোনা ওয়ার্ডটি। শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: সাইফুল ইসলাম জানান, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ভবন কিংবা ইউনিট না থাকায়, প্রতিদিনই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। দেড় বছর আগে ডেডিকেটেড কোভিড নাইনটিন ইউনিটের ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এখনো তা শেষ হয়নি। কাজ দ্রুত শেষ করবার জন্য গণপূর্ত বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল নিয়ে কি ভাবছে স্বাস্থ্য বিভাগ?

সাধারণ চিকিৎসা ব্যাহত না হয়, সেজন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইতোমধ্যে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল ও ডেডিকেটেড কোভিড ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ৮০ লাখের বেশি মানুষের বাস বৃহত্তর বরিশাল তথা বরিশাল বিভাগে এখনো পর্যন্ত কোন ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: বাসুদেব কুমার দাস জানান, ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে যে সংখ্যক চিকিৎসক নার্স ও অন্যান্য কর্মচারী প্রয়োজন তা বরিশালের নেই। সংকট রয়েছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের। যে কারণে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডেডিকেটেড বেড বাড়ানো হচ্ছে।

ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল স্থাপনের জন্য কি প্রয়োজন?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা: কামরুল হাসান খান ভিশননিউজ টুয়েন্টিফোরকে জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরিশালের যেকোনো একটি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালক হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নার্স এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। এটি কোন কঠিন কাজ নয়-মন্তব্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খানের।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্যানুযায়ী, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৬ টি জেলা জেনারেল হাসপাতাল ও ৪০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মিলিয়ে মোট ৪৭ টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে এখনো পর্যন্ত ৬১৩ টি ডেডিকেটেড কোভিড শয্যায় স্থাপন করা হয়েছে।  শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ২২ টি, ভোলা সদর হাসপাতালে তিনটি এবং পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পাঁচটি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়েছে।

চিকিৎসাধীন রোগীর পাশাপাশি প্রতিদিন নতুন রোগী আসায় ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ চিকিৎসা। করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা কিংবা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন; কেউ কেউ যাচ্ছেন ঢাকায়।

অপরদিকে ৪৭ টি হাসপাতালের ৩৯ টি’তে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে অক্সিজেন সংরক্ষনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি জেলা হাসপাতালগুলোর যাদের অক্সিজেন সংরক্ষণের ক্ষমতা আছে, তাদের মেনিফোল্ড পদ্ধতির অক্সিজেন ট্যাংকারগুলোর ধারণক্ষমতা মাত্র ৩ হাজার ৪২০ লিটার করে। এছাড়া গৌরনদী, দুমকি এবং মির্জাগঞ্জসহ ৫ টি উপজেলায় ছোট আকারের মেনিফোল্ড অক্সিজেন রিজার্ভার রয়েছে।

৪৭ টি সরকারী হাসপাতালে ১ হাজার ৯৮ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও, সাড়ে ৫ ,শ  চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন।

সরে জমিনে দেখা গেছে, শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দুইজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চিকিৎসা চলছে। তিন শিফটে ১৫ জন করে ৪৫ জন নার্স আছেন। তারা মূল হাসপাতালের পাশাপাশি করোনা ইউনিটেও কাজ করছেন। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকটের কারণে করোনা ইউনিটির বিভিন্ন জায়গায় গ্লাভস, মাস্কসহ রোগীদের ময়লা আর্বজনায় ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শেবাচিমের করোনা ইউনিটে ভর্তি হওয়া এক রোগীর স্বজন আব্দুল্লাহ মাহাফুজ সবুজ জানান, করোনা ইউনিটের অবস্থা খুবই খারাপ। যেখানে-সেখানে ব্যবহৃত মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভসসহ ময়লা পড়ে আছে। বাথরুম আরও বেহাল। এখানে পানি-সংকট রয়েছে। ফলে রোগীরা আরো অসুস্থ হচ্ছে ।

ঝালকাঠি জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার রতন কুমার ঢালী ভিশননিউজ২৪.কম কে জানান, ঝালকাঠি করোনার সংক্রামণ বাড়ছে। তবে প্রতিরোধে সকল প্রস্তুতি আছে। ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ৪০ আইসোলেশন বেড রয়েছে । তাতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে রোগীর আইসিইউ বেড দরকার হলে শেবাচিম হাসপাতালে পাঠানো হয়।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ডাক্তার সাইফুল ভিশননিউজ২৪.কম কে জানান, শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ইউনিটের জন্য বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছেও জরুরি ভিত্তিতে ১০০ নার্স ও ৫০ জন চিকিৎসক চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের কাছে কিছু স্বেচ্ছাসেবক চেয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘করোনা ইউনিটের জন্য শেবাচিমে কোন নির্দিষ্ট ভবন নেই। আমাদের একটি ভবনকে করোনা ইউনিট করা হয়েছে। ভবনটির কাজ এখনও চলছে। গণপূর্তকে বলা হয়েছে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য।

সবমিলিয়ে চিকিৎসক,নার্সসহ জনবল সংকটে করোনা রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবার মান নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা কি?

প্রতিদিন সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও স্বাস্থ্যবিভাগের মতোই উদাসীন স্থানীয় সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, বিভিন্ন পৌরসভার মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল, বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড ডেডিকেটেড ইউনিট কিংবা আইসোলেশন বেড বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য জানান, বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কথা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তিনি জানান।

খুলনা এবং রাজশাহীর মত করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বরিশালে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান বলেন, বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলের করোনা চিকিৎসায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে রাজধানীর ওপর রোগীর চাপ আরো বাড়বে। ঢাকার হাসপাতালগুলোর পক্ষে তখন সব রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

বরিশালে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: জাহিদ মালেক জানান, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

 

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.