দক্ষিণ চিন সাগরে আধিপত্য থাকবে কার, এই নিয়ে উত্তর-পূর্ব দেশগুলির মধ্যে বিরোধ নতুন নয়। চিনের ‘দাদাগিরি’ আটকাতে প্রায়ই ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া লড়াই করে। আমেরিকার মতো দেশগুলির মধ্যে কেউ কেউ পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েছে এই লড়াইয়ে।
দক্ষিণ চিন সাগরে একাধিপত্য বিস্তার করতে সব সময়ই আগ্রাসী ভূমিকা নেয় বেজিং। এই সাগরে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে নারাজ তারা। ফিলিপিন্স-সহ অন্য দেশগুলিও যে পিছু হটতে নারাজ তা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই এই সব দেশগুলির সঙ্গে সংঘাত লেগেই রয়েছে চিনের।
সেই সংঘাতেই কি এ বার জড়িয়ে পড়ল ভারত? শুক্রবার এ দেশে তৈরি দূরপাল্লার ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ফিলিপিন্সে পাঠাল ভারত। অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলির তালিকায় ভারতের নাম উপরের দিকেই রয়েছে। তবে এ বার যে ভারতও বিদেশে ক্ষেপণাস্ত্র রফতানি করার ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে না, তা শুক্রবারের এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।
প্রথম দফায় ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছল ফিলিপিন্সে। দু’টি ক্ষেপণাস্ত্র, একটি কমান্ড, কন্ট্রোল সেন্টার এবং একটি রাডার ইউনিট ভারত থেকে বিদেশে গেল।
ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ভারতীয় প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। পদাতিক সেনা তো বটেই, বায়ুসেনা এবং নৌবাহিনীও এই ক্ষেপণাস্ত্রে ভরসা রেখে আসছে। রাশিয়া এবং ভারতের যৌথ প্রযুক্তিতে তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে তিন গুণ বেশি জোরে ছুটতে পারে লক্ষ্য অভিমুখে।
ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস এরোস্পেস’ সংস্থা এই ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী। স্থলভূমির পাশাপাশি ডুবোজাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান থেকে ব্রহ্মস ছোড়া সম্ভব।
ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ভারতের সঙ্গে ২০২২ সালে একটি চুক্তি করেছিল ফিলিপিন্স। এই ক্ষেপণাস্ত্রই এ বার হাতে পেল ফিলিপিন্সের নৌবাহিনী। দুই দেশের মধ্যে ৩৭ কোটি ৪০ লক্ষ আমেরিকার ডলারের চুক্তি হয়েছিল। সেই মতো এত দিন কাজ চলছিল। ভারতের মাটিতে তৈরি হওয়া এই ক্ষেপণাস্ত্র তদারক করতে বার কয়েক ফিলিপিন্সের নৌবাহিনীর প্রতিনিধি দল ভারতে এসেছে। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও করেছে।
ফিলিপিন্সের সঙ্গে চুক্তির মাসখানেক পরেই ভারতের মাটি থেকে পাকিস্তানের দিকে ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার ঘটনায় শোরগোল পড়ে যায়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে একটি ব্রহ্মস উড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের উদ্দেশে। পাকিস্তানের দাবি ছিল, ক্ষেপণাস্ত্রটি তাদের আকাশসীমার ১০০ কিলোমিটার ভিতরে শব্দের চেয়ে তিন গুণ গতিতে গিয়ে আছড়ে পড়ে। তবে ক্ষেপণাস্ত্রে বিস্ফোরক না থাকায় বিস্ফোরণ হয়নি।
ভারত যদিও এই ঘটনার পরই দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি জারি করেছিল। নয়াদিল্লির জানায়, ভুল করে পাকিস্তানের দিকে ব্রহ্মস ছোড়া হয়েছিল। পরীক্ষা করার সময়ই এই অঘটন ঘটে। যা নিয়ে দু’দেশের চাপানউতর চলে বেশ কয়েক দিন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ভারতের প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠায়। পাকিস্তান এ ব্যাপারে তদন্তও শুরু করে।
ভারতও এই ঘটনার তদন্ত করে। মাস কয়েক পরে ব্রহ্মস ছোড়ার ঘটনায় বায়ুসেনার তিন জন আধিকারিককে বরখাস্ত করার কথাও জানায় নরেন্দ্র মোদী সরকার। তবে ভারতের এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের নেপথ্যে রয়েছে ফিলিপিন্স, এমনও গুজবও শোনা যায় নানা মহলে।
অনেকেই সে সময় দাবি করেছিলেন, ফিলিপিন্সকে ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি প্রদর্শন করতেই নাকি এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। ভারত বুঝিয়েছিল শত্রুপক্ষের কাছে কতটা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। যদিও এই সব জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছিল ভারত।
ভারতীয় নৌবাহিনীর ভান্ডারে যে সব অস্ত্র রয়েছে তার মধ্যে ব্রহ্মস অন্যতম শক্তিশালী। এটি একটি সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। শত্রুপক্ষের রণতরী নিমেষের মধ্যে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এই দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র। ব্রহ্মস বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র, এমনই দাবি করা হয়। গতির দিক থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকার ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রকেও হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যে কোনও লক্ষ্যবস্তুতে সফল ভাবে আঘাত করতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্র। তা ছাড়া শত্রু দেশের রেডারেও এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম।
ভারতের এই শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রই এ বার ব্যবহার করবে ফিলিপিন্স। দক্ষিণ চিন সাগরে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার করতে পারে তারা।
ভারত থেকে ফিলিপিন্সে ব্রহ্মস পৌঁছতেই চিন্তা বেড়েছে চিনের। সম্প্রতি আমেরিকা ঘোষণা করে ফিলিপিন্সে প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বৃদ্ধি করবে তারা। হোয়াইট হাউসে ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকের পরই এমন খবর প্রকাশ্যে আসে।
চিনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দক্ষিণ চিন সাগরের পাশেই রয়েছে ফিলিপিন্স। ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপরাষ্ট্র। ফিলিপিন্স এবং চিনের বিরোধের অন্যতম কারণ ঘটেছিল সেকেন্ড থমাস শোলে দ্বীপকে কেন্দ্র করে।
১৯৯৯ সাল থেকে ফিলিপিন্সের অধিকারে রয়েছে এই দ্বীপ। পাশাপাশি ফিলিপিন্সের দখলে থাকা শোলে দ্বীপ ২০১২ সালে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় চিন।