The news is by your side.

করোনা পরীক্ষায় টেকনোলজিস্ট নিয়োগে দুর্নীতি!

0 530

 

 

করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়ার জন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স, অভিজ্ঞতাসহ অন্যান্য বিষয় শিথিল করা হয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্য বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভেরিফাইড নয় এমন আইডি থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

এ ধরনের নিয়োগে জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। করোনা পরীক্ষায় দক্ষ জনবল সংকট কাটাতেই এদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তাতে সংকট খুব বেশি কাটবে বলে মনে করেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এর আগে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত নার্সদের পদায়নে দুর্নীতি হয়।

করোনার শুরুতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাস্ক, পিপিইসহ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। ফলে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধন হচ্ছে। আর দুর্ভোগ বয়ে বেড়াচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। করোনার মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি থামছে না। নিয়োগ, পদায়ন এবং কেনাকাটা- সবকিছুতেই দুর্নীতি জড়িয়ে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এরই মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তদন্তে মাঠে নেমেছে।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এবং মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ফোকাল পার্সন মো. হাবিবুর রহমান বলেন, টেকনোলজিস্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি কোনো অনৈতিক লেনদেন হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এসব অনিয়ম কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ডাক্তার ও রোগীদের খাবারের বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়ে তাকে কেউ অবহিত করেননি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের করোনা আক্রান্তদের নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়াতে সোমবার ১২ শ মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ ২৮১৭টি পদে নিয়োগের অনুমোদন চূড়ান্ত হয়। তবে শুরুতেই বিশেষ ব্যবস্থায় ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।

অধিদফতরের মহাপরিচালক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তড়িঘড়ি এই নিয়োগ সম্পর্কিত কাজ শেষ করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধিদফতরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জড়িত। যিনি বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। এক্ষেত্রে জনপ্রতি মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা  জানান।

আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত একাধিক অডিও রেকর্ড হাতে এসেছে। এই অডিওতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সামছুর রহমান কথা বলছেন একজন বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সঙ্গে। সেখানে তিনি বারবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি আশিকুর রহমানের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

কথোপকথনে বলা হয়, ‘চাকরি কনফার্ম হলে টাকা, নইলে নয়। তারা যোগাযোগ করেছে, ২শ’র মতো লোক নেয়ার কথা। জনপ্রতি ১০ লাখের নিচে হলে হবে না। যাদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট হবে তাদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়স শিথিল করা হবে। সংগঠনের মাধ্যমে যারা যাবে, তাদের টাকার সিকিউরিটি সংগঠন দেবে। আজকের মধ্যে তালিকা দিতে হবে। আমাদের টার্গেট যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুযোগ দেয়া হবে। এসব কাউকে বলা যাবে না।’

অপর একটি অডিও রেকর্ডে এক চাকরি প্রার্থীকে বলা হয়, ‘তুমি রাজি থাকলে টাকা রেডি করো, সময় নেই।’ এই অডিও রেকর্ড প্রমাণ করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এই নিয়োগ সম্পন্ন হচ্ছে। এখানে সদ্যঘোষিত বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান ২০০ জনের টার্গেট নিয়ে কথা বলেছেন। তার মধ্যে ১৮৩ জন নিয়োগ পাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে আশিকুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কিছু আমরা করিনি। নিয়োগের সঙ্গে কারা জড়িত, সেটাও আমি বলতে পারব না। এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানে। তবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের প্যাডে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজ করতে ইচ্ছুকদের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসন শাখার কর্মকর্তারা জানান, কোনো নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলে সরকারি নিয়মানুযায়ী ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ তৈরি করার কথা। অর্থাৎ নিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মাবলি ও শর্তসমূহ প্রণয়ন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসনের মাধ্যমে অথবা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের মাধ্যমেই নিয়োগ হবে।

এক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মনীতি উপেক্ষা করে মাত্র একদিনের মধ্যে ১৮৩ জনের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। উল্লিখিত টেকনোলজিস্টদের ২৩টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দেখানো হয়েছে, যা মোটেও সত্য নয়। এমনকি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একটি ‘নন ভেরিফাইড’ ইমেইল আইডি থেকে তথ্য প্রদান করতে বলা হয়।

অনুসন্ধনে দেখা যায়, ৩১ মে ‘covidreport20-gmail.com থেকে অধিদফতরের আওতাধীন এক প্রতিষ্ঠান পরিচালককে একটি মেইল পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, ‘আপনার প্রতিষ্ঠানের অধীনে পিসিআর ল্যাবে যদি কোনো মেডিকেল টেকনোলজিস্ট স্বেচ্ছায় কাজ করে থাকে, তাদের তথ্য নিম্নলিখিত ছক মোতাবেক ১ জুন সকাল ১০টার মধ্যে এই মেইল অ্যাড্রেসে পাঠানো হবে।’

এ ধরনের আইডি থেকে ইমেইল আসায় ওই পরিচালক সন্দেহ প্রকাশ করেন। এরপরও তিনি তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় অর্ধশত টেকনোলজিস্টের নামের তালিকা ২ জুন পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তাকে পরিচালক প্রশাসনের দফতর থেকে জানানো হয়, তালিকা জুনের ১ তারিখেই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন আর কিছুই করার নেই।

অথচ বিভিন্ন ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রম দেয়া টেকনোলজিস্টদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন ল্যাবের কাছে তালিকা চাওয়া হয়। তবে ল্যাব থেকে পাঠানো সব তালিকা শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা  নিশ্চিত করেন, অধিদফতরের কোনো নির্দেশনা বা যোগাযোগ ব্যক্তিগত মেইলে করার সুযোগ নেই। কারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ইমেইল আইডির সঙ্গে dghs.gov.bd সংযুক্ত থাকে। অর্থাৎ অনিয়মের উদ্দেশ্যে এ ধরনের অফিশিয়াল ভেরিফাইড মেইলে ছাড়া অন্য আইডি থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। যাতে কাউকে অভিযুক্ত করা সম্ভব না হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের এক পরিচালক এবং একজন প্রোগ্রাম ম্যানেজার (পিএম)বলেন, যখন অধিদফতরের মহাপরিচালক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখন তড়িঘড়ি করে এই তালিকা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর সঙ্গে অধিদফতরের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত। বিপুল পরিমাণ অর্থিক লেনদেন করে যোগ্য নয় এমন ব্যক্তিদের টেকনোলজিস্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ৩ জুন এই ১৮৩ জনের নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন নেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘দ্য সেন্ট্রাল ক্লোজেজ অ্যাক্ট ১৮৯৭ এর ১৫ ধারা অনুযায়ী নিয়োগের শিক্ষাগত যোগ্যতা ব্যতীত অন্যান্য যোগ্যতা এবং স্বাভাবিক নিয়ম প্রমার্জনা করে নিয়োগ করার অনুরোধ করা হল।’ এই মর্মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব খন্দকার জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত এক স্মারক থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

স্মারকে যে প্রমার্জনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অডিও রেকর্ডের কথোপকথনেও চাকরি প্রার্থীকে সেই আশ্বাস দেয়া হয় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে। অর্থাৎ অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশেই এই কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. বেলাল হেসেন যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা চাওয়া হলে অধিদফতর থেকে ১৮৩ জনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ প্রমার্জনায় তাদের এই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এখনে অনিয়মের কিছু হয়নি। অধিদফতরের ভেরিফাইড নয় এমন ইমেইল আইডি থেকে কেন তথ্য চাওয়া হল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই আইডিটি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ নিয়োগের সুপারিশ অবিলম্বে বাতিলের দাবিতে ‘বেকার অ্যান্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ এর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবর ৮ জুন একটি আবেদন করা হয়। সেখানেও এ সংক্রান্ত যাবতীয় অনিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের হাসপাতালগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে দেশে করোনা মহামারী শুরু হওয়ায় ল্যাবরেটরিগুলোর কার্যক্রম বাড়াতে হয়েছে। ফলে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক ও নার্সের মতো টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি ওঠে। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, করোনা মহামারী অবস্থায় স্বাস্থ্য খাতে প্রথম অনিয়ম শুরু হয় মার্চের প্রথম সপ্তাহে পিপিই ও এন৯৫ মাস্ক কেনার মাধ্যমে, যা বর্তমানে দুদকে তদন্তাধীন। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের দৈনন্দিন খাবার খরচ হিসাবে ৫শ’ টাকা এবং রোগীদের জন্য ৩শ’ টাকা বরাদ্দ করা হয়।

কিন্তু রোগীদের জন্য সব হাসপাতালে আগের নিয়মে খাবার দেয়া হচ্ছে। এ খাতের বরাদ্দকৃত টাকা নয়ছয় হচ্ছে। সম্প্রতি পাঁচ হাজারেরও বেশি নার্স নিয়োগ ও পদায়ন করা হয়। এদের কোভিড-১৯ নির্ধারিত হাসপাতালে পদায়ন করার কথা। কিন্তু অবৈধ সুবিধা নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। এসব হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত নয়। সব মিলে করোনাকালেও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি থামছে না। উল্টো দিন দিন বেড়েই চলেছে।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দুর্নীতি-অনিয়ম মাথাচাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এখানে অতীতের ধারা অব্যাহত রয়েছে, অনৈতিক কার্যক্রম চলমান রেখেছে। আশা করছি, এই অশুভ শক্তির ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।

 

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.