এখনও পুরোপুরি মরে যায়নি লাল গ্রহ। এখনও ‘বিপ্লব স্পন্দিত’ মঙ্গলের বুকে! বদলাচ্ছে তার গঠন। বদলাচ্ছে তার অন্দর। আর সেই বদলানোর জাদুকাঠিটা এখনও রেয়েছে মঙ্গলের বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনও ‘ম্যাজিশিয়ান’-এর হাতে!
ভূমিকম্পে যেমন থরথর করে কেঁপে ওঠে পৃথিবী. দুলে ওঠে মাটি, ফুলে-ফেঁপে ওঠে সাগর, মহাসাগর, এই প্রথম দেখা গেল ঠিক তেমনটাই ঘটে মঙ্গলেও। যার জেরে মঙ্গলের অন্দরের সেই চাপা কান্না শুনল নাসার পাঠানো মহাকাশযান ‘ইনসাইট’-এর ল্যান্ডারে থাকা ‘সিসমিক এক্সপেরিমেন্ট ফর ইন্টিরিয়র স্ট্রাকচার’ (সিস) যন্ত্রটি। যা আদতে একটি ফরাসি যন্ত্র। শুধু সেই চাপা কান্না শুনেই চুপ করে বসে থাকেনি ‘সিস’, রেকর্ড করে তা পাঠিয়েও দিয়েছে গ্রাউন্ড স্টেশনে। তার পর সেই শব্দকে আমাদের শ্রবণযোগ্য করে তোলা হয়েছে।
মঙ্গলের সেই চাপা কান্না শোনা গিয়েছে কবে?
নাসার তরফে জানানো হয়েছে, মোটামুটি ভাল ভাবে তা শোনা গিয়েছে গত ৬ এপ্রিল। তবে তার আগে, পরে আরও তিন দিন ওই শব্দ শুনেছে সিস। যদিও তা খুবই নীচু স্বরে। গত ১৪ মার্চ, ১০ এপ্রিল এবং ১১ এপ্রিলে।
মঙ্গলে নাসার ল্যান্ডার ইনসাইট পা ছোঁয়ানোর ১২৮তম দিনে ঘটেছে এই ঘটনা। যা পৃথিবীর সাড়ে ১২৫ দিনের সমান। কারণ, পৃথিবীর দিন-রাতের আয়ু যতটা, মঙ্গলের দিন-রাতের আয়ুও প্রায় ততটাই। পৃথিবী নিজের কক্ষপথে লাট্টুর মতো ঘুরতে যে সময় নেয় (২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট), তার চেয়ে সামান্য কিছুটা বেশি সময় নেয় লাল গ্রহ। ঘণ্টার হিসেবে তাই মঙ্গলের একটি দিন (দিন ও রাত মিলে) আমাদের চেয়ে সামান্য একটু বড়। তার দৈর্ঘ্য ২৪ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট থেকে ২৪ ঘণ্টা ৩৯ মিনিটের মধ্যে। এটাকেই বলে ‘সল’।
আরও সহজ ভাবে বলতে হলে, মঙ্গলে নামার পর প্রথম যে দিন তার মাথার উপর সূর্যকে দেখতে পেয়েছিল ইনসাইট, তার থেকে ঠিক ১২৮ দিনের মাথায় যখন ১২৮ বারের জন্য সূর্যটা তার মাথার উপরে এল, ঠিক তখনই লাল গ্রহের অন্দর থেকে বেরিয়ে আসা সেই চাপা কান্না শুনতে পেয়েছিল নাসার মহাকাশযান।
ওয়াশিংটনে নাসার সদর দফতর থেকে মিশন অপারেশনসের সায়েন্স অপারেশন ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ আনন্দবাজার ডিজিটালকে ই-মেলে লিখেছেন, “এটা একটা অসাধারণ সাফল্য। অভূতপূর্ব। এই প্রথম মঙ্গলের কম্পন ধরা পড়ল আমাদের কোনও যন্ত্রে। লাল গ্রহের অন্দরে এখনও কী কী ঘটে চলেছে, তা জানাতে এই ঘটনা খুবই সাহায্য করবে। কম্পন যেহেতু তরঙ্গই, তাই তা আরও ছড়াবে। আর তা যত ছড়াবে, ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল। কারণ, এই ধরনের কম্পনের ঘটনা আরও বাড়বে। আমাদের পাঠানো সিস যন্ত্রটি আরও ভাল ভাবে শুনতে পারবে লাল গ্রহের অন্দরের সেই গোঙানি। আর সেই সব খতিয়ে দেখেই আমরা জানতে পারব. মঙ্গলের একেবারে ভিতরটা (কোর) কোন কোন পদার্থ দিয়ে গড়া, সেগুলি রয়েছে কী কী অবস্থায়, সেটা কতটা পুরু, সব কিছুই। জানতে পারব লাল গ্রহের ম্যান্টলটা কেমন? তা কোন কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি? জানতে পারব, কোন ধরনের পরিবর্তন এখনও হয়ে চলেছে মঙ্গলের সেই ভিতরটার ঠিক উপরে থাকা স্তরটির মধ্যে (ক্রাস্ট, যা মঙ্গলের পিঠ পর্যন্ত বিস্তৃত)। কত দিন আগে শেষ কম্পন অনুভুত হয়েছিল মঙ্গলের অন্দরে? তা কত বার হয়েছে লাল গ্রহের জন্মের পর থেকে? জানতে পারব, কী ভাবে মঙ্গল গ্রহের জন্ম হয়েছিল? আর কী ভাবেই বা তার কোর, ম্যান্টল আর ক্রাস্টটা তৈরি হয়েছিল?”
একই কথা বলেছেন কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা সন্দীপ চক্রবর্তীও। তাঁর বক্তব্য, এ বার হয়তো খুব শীঘ্রই এমন আরও কম্পন অনুভব করতে পারবে সিস। কারণ, চেহারায় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লাল গ্রহ। তার ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় অর্ধেক। ফলে, কম্পনের ফলে যে তরঙ্গের জন্ম হয়েছে, তা ছড়াতে বেশি সময় লাগবে না। যেমন ২০০৪-এ ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় সেই ভয়াবহ সুনামির পরল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভূমিকম্প হয়েছিল একের পর এক, অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে। এমন কম্পন মঙ্গলে হয় বলে গত সাতের দশক থেকেই ধারণা ছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু প্রযুক্তির অভাবে এত দিন তা টের পাইনি আমরা।
মঙ্গলের এই কম্পনের কারণ কী?
সন্দীপ বলছেন, “ধরুন কড়াইতে ঝোল ফুটছে। আর তার ফলে, উপরে ভাসা ছোট একটি কাঠের টুকরো উপরে উঠছে আর নামছে। সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কখনও বা কিছুটা পিছু হঠছে। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটছে। মঙ্গলের কোরের তাপমাত্রা দেড় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। যে তাপমাত্রায় লোহা বা ইস্পাতের মতো ধাতু বা ধাতব পদার্থ গলে না ঠিকই, কিন্তু তা শিলা, পাথর গলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্টই।ফলে, পৃথিবীর কোরে যেমন রয়েছে লোহার গনগনে স্রোত, লাল গ্রহের অন্দরটাও তেমনই। তার উপর রয়েছে মঙ্গলের ক্রাস্ট। কোরের সেই গনগনে স্রোতের জন্য ক্রাস্টের ওঠা-নামা হচ্ছে। সেগুলি এ-দিক, ও-দিকে সরে যাচ্ছে। তাদের সংকোচন হচ্ছে। ফলে, নড়াচড়া হচ্ছে মঙ্গলের পিঠের ঠিক নীচেই।
সেটা কি আমাদের ভূমিকম্পের মতোই?
পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) বিশিষ্ট বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদ গৌতম চট্টোপাধ্যায় ই-মেলে আনন্দবাজার ডিজিটালকে জানিয়েছেন, তফাৎ রয়েছে।পৃথিবীতে ভূকম্পনের জন্য দায়ী থাকে বিভিন্ন টেকনোটনিক প্লেটের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি। সেই ধাক্কাধাক্কিতে একটি প্লেট চলে যায় অন্য প্লেটের নীচে। তার ফলে কোনও কোনও এলাকায় তৈরি হয় ফাটল বা চ্যূতি। আর সেই ফাটল ধরেই কোরে জন্মানো শক্তি বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। তখনই হয় ভূকম্প। আর পৃথিবীর ম্যান্টলে থাকা অসম্ভব গরম পদার্থের তরল স্রোত উপরে উঠে আসে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের সময়। কিন্তু মঙ্গলে কোনও টেকনোটনিক প্লেট নেই। সেখানে ক্রাস্টের বালিকণার নড়াচড়ার ফলেই তৈরি হয় কম্পন। এটাই মার্সকোয়েক।
মঙ্গলের অন্দরের সেই রদবদলটা কী ভাবে বোঝা যাবে?
গৌতমের কথায়, “ধরুন, আপনার সামনে রয়েছে একটি কাঁচা ডিম আর সিদ্ধ ডিম। সেগুলিকে একটি টেবিলের উপর রেখে তাদের লাট্টুর মতো ঘুরিয়ে দিন। দেখবেন, দু’টি ডিম দু’রকম ভাবে ঘুরছে। সেই ভিন্নতা দেখেই জানা সম্ভব ওই ডিমদু’টির মধ্যে কী রয়েছে। শক্ত কুসুম নাকি তরল রস।”
লাল গ্রহের এই কম্পনে আর কী জানা যাবে?
সন্দীপ জানাচ্ছেন, জন্মের পর নিজের কক্ষপথে কতটা জোরে ঘুরতো লাল গ্রহ। কারণ, প্রতিটি ভূকম্পন হলে যেমন দিন-রাতের আয়ু একটু একটু করে কমে পৃথিবীতে, একই ঘটনা ঘটে মঙ্গলেও। তা ছাড়া, যে কোনও কম্পনেই সংকোচন হয়। ফলে, বার বার ভূকম্পনে মঙ্গলও আগের চেয়ে আকারে ছোট হয়েছে কি না, হলে তা কতটা এ বার সেটাও জানার রাস্তাটা খুলে গেল।