The news is by your side.

বিশ্বকাপে ট্যুরিস্ট হতে আসেনি বাংলাদেশ, এসেছে বিশ্বকে বাঘের হুঙ্কার শোনাতে

0 656

 

নিজেদের সর্বোচ্চ ৩৩০ রান করে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই টাইগাররা হারিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ওভাল- ইতিহাস আর ঐতিহ্যের লালিত ইংলিশ ক্রিকেটের সেই জমিদারবাড়ি থেকেই বিশ্বকাপের জয়যাত্রা শুরু হলো টাইগারদের। ২১ রানের এই জয় প্রতিষ্ঠিত করল যে, এবারের বিশ্বকাপে ট্যুরিস্ট হতে আসেনি বাংলাদেশিরা, এসেছে পুরো বিশ্বকে বাঘের হুঙ্কার শোনাতে। গতকাল সেই হুঙ্কারে যেন কেঁপে উঠল লন্ডন, ওভালের বাংলাদেশ… বাংলাদেশ… জয়োধ্বনি যেন নাড়িয়ে দিল ঘুমন্ত বিগ বেনকেও।

প্রেসবক্সে থাকা নাকউঁচু ব্রিটিশ সাংবাদিকরা মাশরাফিদের এই জয়কে লিখেছেন ‘আপসেট’- লিখুক তারা। ওরা কোন কালেই বা কৃতিত্বটা দিয়েছে, গেল দুই বিশ্বকাপে টাইগারদের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার স্মৃতিটা এই ব্রিটিশ সাংবাদিকরা ভুলতে পারেননি। ষোলো কোটি বাংলাদেশি তো জানে অঙ্কটা- মাথা ঠাণ্ডা রেখে একটি একটি করে শিকার করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা হলো- এবার কে আসবি আয়! এদিন মাঠে সোনার বাংলা… সুর বাজার পর থেকেই লাল-সবুজের বুক ফোলানো দাপট দেখতে থাকে ওভাল। সৌম্যর বিধ্বংসী শুরুর পর সাকিব-মুশফিকের অভিজ্ঞ ব্যাটিং, শেষে এসে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে মোসাদ্দেকের ফিনিশিং- সব মিলিয়ে ইতিহাসের ভেঙে যাওয়া দেয়ালগুলোই যেন সংস্কার করছিল টাইগাররা। তার পরও তিনশ’ ত্রিশ করেও যে টেনশন ফ্রি হয়ে কফির মগ নিয়ে কেউ গ্যালারিতে বসতে পারেননি। প্রোটিয়াদের ওপেনিং জুটি ভাঙতে মুশফিককে গ্লাভস খুলে থ্রো করতে হয়েছে। মার্করামকে বোল্ড করতে সাকিবকে আর্মার ব্যবহার করতে হয়েছিল। মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিস ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার মুখে লন্ডনের বিখ্যাত বাজি সংস্থা বেটিংডটকমের রেট দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষেই ছিল ৬২/৪৮। কিন্তু মিরাজের ভেলকিতে বোকা বনে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান ৬২ রান করা প্লেসিস।

১৪৭ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর থেকেই ম্যাচের রঙ বদলে যেতে শুরু করে। তার পরও ১৬ রানে থাকা মিলারের ক্যাচ মিডঅনে ফসকে যায় সৌম্যর। কিছু মিস ফিল্ডিংয়ে বাড়তি রানও গলে যায়। ডুমিনি রিভিউ নিয়ে মুস্তাফিজের কাছ থেকে এলবিডব্লিউতে জীবন ফিরে পান- সব মিলিয়ে নখ কামড়ানো একটা অস্বস্তি ছিল গোটা ওভালজুড়েই। কিন্তু ওই সময় মুস্তাফিজের স্পেলটি ছিল অসাধারণ। ওভারে আইন মেনে একটি করে বাউন্সার দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সুইংও করাতে পারছিলেন, কিছু স্লোয়ার, কাটারও ভাণ্ডার থেকে বের করছিলেন। মিলারকে পয়েন্টে ক্যাচ বানিয়েছিলেন তিনিই। চিন্তাটা ছিল সাইফউদ্দিনকে নিয়েই বেশি। ইনজুরি থেকে মাত্রই ম্যাচে ফেরা সাইফউদ্দিনকে রুবেলের বদলে একাদশে নেওয়ায় খানিকটা কথা হচ্ছিল প্রেসবক্সে। আসলে ঘণ্টায় একশ’ চল্লিশ গতির এক বোলারকে ইনিংসের মাঝে প্রয়োজন মনে হচ্ছিল। কিন্তু সাইফউদ্দিন এসে মারকুটে ডুসনকে বোল্ড করেছিলেন, ফেলুকাওকেও সাকিবের ক্যাচ বানিয়েছিলেন। অধিনায়ক এক ওভার এক ওভার করে সাইফউদ্দিনকে ব্যবহার করেছেন।

ওভালে সূর্য ঢলে পড়ার মুখে ১৮ বলে ৪৪ রান দরকার ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। গলার কাঁটা হয়ে ছিলেন কেবল ডুমিনি; শেষ পর্যন্ত মুস্তাফিজ সেই কাঁটা তুলে আনতেই বাংলাদেশিদের আকাশ কাঁপানো চিৎকারে নড়ে যায় ওভাল। টাইগারদের ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হয় আরেকটি অধ্যায়।

এদিন ম্যাচের শুরু থেকেই চুইংগাম চিবোতে চিবোতে ফিল্ডিং করতে নামা ফাফ ডু প্লেসিস কিংবা তেড়েফুঁড়ে আসা লুঙ্গি এনগিডি- সৌম্য, সাকিব, মুশফিকদের সামনে অসহায় মনে হয়েছে। বাংলাদেশিরা যে ব্যাট হাতে এতটা চড়াও হবে, তা যেন কল্পনাতেও ছিল না তাদের! যে কারণে মুশফিক আর সাকিব জুটিতে যখন একশ’ পার করে- তখন ধারাভাষ্যকারের রুম থেকে জন্টি রোডসের তিন শব্দের টুইট- ‘ওকে, টাইম টু প্যানিক’। ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকানদের হার্টের যে ব্লক আছে সেটা তো সবারই জানা। চাপের মুখে ভেঙে পড়ার কারণেই তো তাদের ওই চোকার অপবাদ। এদিন তাদের সেই অসুস্থ হার্টে প্রথম আঘাতটি করেছিলেন সৌম্য সরকার। ড্রেসিংরুমের বলে দেওয়া নির্দেশই ছিল- তামিম থাকবেন তামিমের মতো বটবৃক্ষ হয়ে, সৌম্য সেখানে ঝড় তুলবেন তার মতো করে। রাবাদা আর এনগিডির শরীর বরাবর তাক করা শর্ট বলগুলো স্কয়ার অব বাউন্ডারির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন সৌম্য। কপালটাও সঙ্গে ছিল তার, স্লিপের মাঝখান দিয়ে তাই কয়েকটি বাউন্ডারির রাস্তাও বের করছিলেন। একসময় ১৯ বলে ৩৫ চলে আসে সৌম্যর কবজির মোচড় আর তুলে মারা শট থেকে। তামিম অবশ্য গিয়ার তুলছিলেন ১৩ বলে ৪, ১৮ বলে ৮, ২৭ বলে ১৬ করে- হাতে চোট নিয়েই দলের হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ফেলুকাওয়ের একটি শর্ট বলে নিজের উইকেট বাঁচাতে পারেননি।

টিম প্ল্যান ছিল, তামিম অন্তত প্রথম দশ ওভার ক্রিজে থাকবেন। সেখানে এক ওভার আগে আউট হয়ে যাওয়ার পর সৌম্যর সামনে হাফসেঞ্চুরি করার দারুণ এক সুযোগ ছিল। কিন্তু মরিসের স্লোয়ার বাউন্সারে টাইমিংয়ে গণ্ডগোল হয়ে যায় তার। ১৪০ স্ট্রাইক রেট নিয়ে সৌম্য ফেরেন ৪২ রান করে। ৬০ রানে ওপেনিং জুটির পর ৭৫ রানে দুই উইকেট। সাধারণত এ জায়গাতেই ‘প্যানিক’ সৃষ্টি হয় টাইগারদের মধ্যে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে আসা এই দলটি যে অতীত ভাঙার পণ করেই এসেছে ইংল্যান্ডে। তাই সাকিব আর মুশফিক, দলের দুই অভিজ্ঞজনই সংসারের হাল তুলে নেন কাঁধে। সাকিব তার ফেভারিট সুইপগুলো খেলতে থাকেন, আর মুশফিক তার ধ্রুপদি কাভার ড্রাইভ। গোটা গ্যালারি এই দু’জনের ব্যাটিংশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে যায়। প্রেসবক্সে পাশে বসে থাকা লন্ডনের সান্ধ্য দৈনিকের এক সাংবাদিকও তার এডিটরকে ফোন করে বলে দেন, এই দু’জনকে নিয়েই তার লেখার শিরোনাম হবে। ঐতিহাসিক ম্যাচে সাকিব নিজেও তার একটা মাইলফলক ছুঁয়ে নেন। জ্যাক ক্যালিসকে ছাপিয়ে অলরাউন্ডার হিসেবে দ্রুততম দুইশ’ উইকেট আর সব ফরম্যাটে এগারো হাজার রান তোলার রেকর্ড গড়ে নেন। সাকিব-মুশফিক মিলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১৪২ রানের জুটিও গড়ে তোলেন দু’জন। সেঞ্চুরির হাতছানি ছিল তাদের দু’জনের সামনেই। কিন্তু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, দু’জনের লক্ষ্যই ছিল দলের জন্য স্ট্রাইক রেট আরও বাড়িয়ে তোলা। তাই সাকিবের ৭৫ কিংবা মুশফিকের ৭৮ রানের মূল্যমান নিহিত ছিল নব্বই আর আটানব্বই স্ট্রাইক রেটে।

বাটন দুটো দিয়ে যান তারা মিঠুন আর মাহমুদুল্লাহকে। এসেই ছক্কা হাঁকিয়ে মিঠুন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দলের জন্য পরের ম্যাচে জায়গা নিশ্চিত করতে তিনি মাঠে নামেননি। ছক্কা হাঁকিয়ে খাতা খুলেছিলেন তিনি। এরপর মাহমুদুল্লাহ লেলিয়ে দিয়েছিলেন মোসাদ্দেককে। চারটি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন মোসাদ্দেক মোক্ষম সময়ে। দলের স্কোরও তিনশ’ পার করেছিলেন। রিয়াদ অপেক্ষায় ছিলেন শেষ ওভারে রাবাদাকে নিয়ে ছক্কা-ছক্কা খেলতে। একটা পেরেছিলেন, অবশ্য তাতেই বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান তুলে নেয়। এর আগে পাকিস্তানের সঙ্গে ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে ৩২৯ রানই ছিল টাইগারদের শ্রেষ্ঠত্বের মাইলফলক।

এদিন সেই মাইলফলক ছাড়িয়েও পুরো ক্রিকেটবিশ্বকে একটি বার্তা দিয়ে রাখল টাইগাররা, পাকিস্তান-শ্রীলংকা পারেনি বলে এশিয়ার কেউ পারবে না, সেই ধারণা ভুলে যাও। শুচিবাইগ্রস্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে স্বীকার করো- এই বিশ্বকাপের চার ফেভারিট বলার সময় বাংলাদেশের নামটি বলতে যেন আর ভুল না হয়। বুধবার এই ওভালেই আবার দেখা হবে- নেক্সট ইজ নিউজিল্যান্ড!

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.