ব্যাংকঋণের টাকায় ব্যবসা শুরু। ব্যবসা সম্প্রসারণও ঋণের টাকায়। ব্যাংকঋণে গড়ে তোলা এ সম্পদ ঋণগ্রহীতার অবর্তমানে ভোগ করছেন তার উত্তরাধিকারীরা। কিন্তু ঋণের দায় নিতে রাজি নন তারা। যদিও ঋণ পরিশোধের সব সামর্থ্য আছে তাদের। উত্তরাধিকারীদের এ অনীহায় ঋণের টাকা আদায়ে অনিশ্চয়তায় পড়ছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক এশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে গম আমদানি ও ফ্লাওয়ার মিল গড়ে তোলেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম। ২০১১ সালে এ ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পর টাকা উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা মরহুম শাহ আলমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ঋণের টাকা পরিশোধে এগিয়ে আসেননি পরিবারের কেউ। শাহ আলমের প্রতিষ্ঠান মেসার্স শাহ আলম অ্যান্ড সন্সের কাছে ব্যাংক এশিয়া শেখ মুজিব রোড শাখার বর্তমান পাওনা প্রায় ১১৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৪ সাল থেকে ব্যাংক এশিয়া শেখ মুজিব রোড শাখার সঙ্গে লেনদেন শুরু ব্যবসায়ী মো. শাহ আলমের। এরপর বিভিন্ন সময়ে তার তিনটি প্রতিষ্ঠান শাহ আরজু ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স শাহ আলম অ্যান্ড সন্স ও মেসার্স হাজি মো. শাহ আলমের নামে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন তিনি। ২০১১ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন ব্যাংকটিতে তার ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০ কোটি টাকা।
দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ২০১৬ সালে ঋণগ্রহীতার ওয়ারিশদের (উত্তরাধিকারী) বিবাদী করে মামলা করে ব্যাংকটি। আদালতের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের আগস্টে শাহ আলমের কাছে ব্যাংক এশিয়ার পাওনা ছিল ৮৯ কোটি ৭১ লাখ ৫৩ হাজার ৫২৮ টাকা। মামলায় শাহ আলমের স্ত্রী, দুই ছেলে, চার মেয়েসহ মোট সাতজনকে বিবাদী করা হয়।
ব্যাংক এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিব রোড শাখার শাখাপ্রধান আলী তারেক পারভেজ বলেন, ঋণগ্রহীতা মো. শাহ আলম মারা যাওয়ার পর তার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দিয়েও ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাদের। কিন্তু ঋণ পরিশোধে কোনো আগ্রহ দেখাননি তারা। বরং তাদের পক্ষ থেকে আদালতে বারবার পিটিশনের মাধ্যমে মামলায় সময়ক্ষেপণ হয়েছে। অথচ ঋণগ্রহীতার (শাহ আলম) গড়ে যাওয়া সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীরা দিব্যি ভোগ করছেন।
ঋণ পরিশোধ না করলেও নগরীর অক্সিজেন এলাকায় শাহ আরজু ফ্লাওয়ার মিলটি ভালোই চলছে। চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী মোড়ে এ পরিবারের রয়েছে নিজস্ব বহুতল ভবন। অক্সিজেন মোড়ে নিজেদের কেনা জমিতে বহুতল ভবন তুলে পোশাক কারখানা হিসেবে ভাড়া দিয়েছে পরিবারটি। চট্টগ্রামের আরো বেশকিছু এলাকায়ও জমি রয়েছে তাদের।
একই ব্যবসায়ীর মেসার্স আরমান ট্রেডিংয়ের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখারও প্রায় ২০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। শাহ আলমের মৃত্যুর পর সমঝোতার মাধ্যমে এ টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যাংকটি। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকও শাহ আলমের উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আলমের ছেলে শাহ মো. ইমরান বলেন, বাবা ব্যাংকের ঋণ রেখেই মারা যান। বড় অংকের ঋণ হওয়ায় তা পরিশোধে সময় লাগছে। কারণ আমরা এখন সাতজন ওয়ারিশ। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুদ মওকুফসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক এরই মধ্যে মামলাও করেছে। আইনি প্রক্রিয়ায়ও বিষয়টি সুরাহার সুযোগ রয়েছে।
খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হোসেনের মৃত্যুর পরও একই সংকটে পড়েছে পাঁচটি ব্যাংক। ২০১৫ সালে মারা যাওয়ার পর এ ব্যবসায়ীর উত্তরাধিকারীদের কাছে আটকে গেছে ব্যাংকগুলোর প্রায় ২২৭ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রয়াত মোহাম্মদ হোসেন ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ঋণ রয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। এছাড়া প্রাইম ব্যাংক লালদীঘি শাখার ঋণের পরিমাণ ৪৫ কোটি, এবি ব্যাংক আন্দরকিল্লা শাখার ৩০ কোটি, পূবালী ব্যাংক চাক্তাই শাখার ২৪ কোটি ও ব্যাংক এশিয়া স্টেশন রোড শাখার ১৩ কোটি টাকা। সব ঋণই এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শাহাদত হোসেন বলেন, ঋণের টাকা উদ্ধারে আমরা অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছি। মামলাটি এখন রায় ঘোষণার পর্যায়ে রয়েছে। এর আগে ঋণের বিপরীতে প্রয়াত মোহাম্মদ হোসেনের বন্ধক রাখা ১১০ শতক জমি নিলামে বিক্রির চেষ্টা করেছি। কিন্তু উপযুক্ত দরে কিনতে আগ্রহী কোনো ক্রেতা না মেলায় তা বিক্রি সম্ভব হয়নি। মামলার রায় হলে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ঋণের টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে বলে জানান তিনি।
পূবালী ব্যাংক চাক্তাই শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, শাহ আমানত ফ্লাওয়ার মিলের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ২৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হোসেন মারা যাওয়ার পর থেকে ঋণের ওপর সুদ আরোপ করা হচ্ছে না। তার পরও মোহাম্মদ হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার মনোভাব খুবই কম। অথচ মোহাম্মদ হোসেনের গড়ে যাওয়া প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে, যা তার উত্তরাধিকারীরা ভোগ করছেন।
মোহাম্মদ হোসেনের উত্তরাধিকারীদের একজন তার ছেলে মাঈনুদিন হোসেন। তিনি বলেন, বাবা বেশ সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার ব্যবসায়িক অংশীদার প্রতারণা করেন। পাওনাদার ব্যাংকগুলো টাকা উদ্ধারে মামলা করেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে ব্যাংক পাওনা আদায় করবে।
ব্যাংকঋণে গড়ে তোলা সম্পদ ভোগদখল করলেও ঋণের দায় নিতে চাইছেন না চট্টগ্রামের আম্বিয়া গ্রুপের কর্ণধার প্রয়াত আবুল কাশেমের উত্তরাধিকারীরাও। আবুল কাশেমের রেখে যাওয়া হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভোগ করছেন তার স্ত্রী ও সন্তানরা। অথচ বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পরিশোধে এগিয়ে আসছেন না তাদের কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবা হাজি সফির হাত ধরে পারিবারিক ব্যবসায় আসেন চট্টগ্রামের পতেঙ্গার আবুল কাশেম। একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে নাম দেন ‘আম্বিয়া গ্রুপ’। প্রথম দিকে শিপব্রেকিং খাতে ব্যবসা করলেও পরে ইস্পাত, গার্মেন্টস, কাগজ, আবাসন, শিপিং, কনজিউমার, জ্বালানি, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। বিশেষ করে ইস্পাত ও গার্মেন্টস খাতে বেশ সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে গ্রুপটি। কিন্তু ২০১১ সালে তার আকস্মিক মৃত্যুর পর ব্যাংকের পাওনা আটকে যায়।
জানা গেছে, আম্বিয়া গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, যা খেলাপি হয়ে পড়েছে। গ্রুপটির কাছে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার। গ্রুপটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্টিলের কাছে ব্যাংকটির পাওনা প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। এছাড়া আবরার স্টিলের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার সাড়ে ৬৯ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখার ১৬ কোটি, কিউএস স্টিলের কাছে এনসিসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৩২ কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৪ কোটি টাকা পাওনা আটকে গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮-১০ সালের মধ্যে এসব ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেন আম্বিয়া গ্রুপের কর্ণধাররা। গ্রুপটির যে পরিমাণ ব্যবসা ছিল, সে হিসেবে এসব ঋণের অংক বেশি বড় নয়। কিন্তু পারিবারিক অন্যৈকের কারণে ব্যবসায় মন্দা শুরু হলে ঋণ পরিশোধে কেউ এগিয়ে আসছেন না। এতে সুদ বেড়ে ব্যাংকের দেনা বেড়ে যাচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক নায়ের আজম বলেন, গ্রুপটির ইস্পাত খাতের ব্যবসায় ঋণ দেয়া হয়। শিপব্রেকিং-ইস্পাত খাতের ব্যবসায় মন্দা শুরু হলে ঋণের টাকা আটকে যায়। এর মধ্যে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মারা গেলে ঋণ আদায় আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। গ্রুপটির অন্য খাতে ভালো ব্যবসা থাকলেও ঋণ পরিশোধে কেউ এগিয়ে আসছেন না। পাওনা আদায়ে এখন আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় আছি।
ঋণ আদায়ে মামলা করেছে ব্যাংক এশিয়াও। ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার প্রধান একেএম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে ভালো ব্যবসা করেন চট্টগ্রামের আম্বিয়া গ্রুপের কর্ণধার আবুল কাশেম। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর বাকি কর্ণধারদের অনৈক্যের কারণে গ্রুপের ব্যবসায় ধস নামে। এরপর ব্যাংকের দেনা পরিশোধে কেউ এগিয়ে আসছেন না। অথচ প্রতিষ্ঠানটির যথেষ্ট সম্পত্তি রয়েছে। পাওনা আদায়ে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।