উষ্ণায়নের দরুন মহাসাগর আর সমুদ্রের জল উত্তরোত্তর যে ভাবে গরম হয়ে উঠছে তাতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বরফের চাঙড়টিও আর ক’দিন পর হয়তো গলতে শুরু করবে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস (পিনাস)’-এ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বরফের চাঙড়টি (‘আইস শিট’) রয়েছে দক্ষিণ মেরুতে। নাম- ‘ইস্ট অ্যান্টার্কটিক আইস শিট’। পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুও রয়েছে এই ইস্ট অ্যান্টার্কটিকায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই দৈত্যাকার বরফের চাঙরটির উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার মিটার। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার প্রায় ৩৫/৪০ ভাগ!
এই বরফের চাঙড়টিতে এখনও যতটা বরফ রয়েছে তার আয়তন ২ কোটি ৭০ লক্ষ ঘন কিলোমিটার। এই বরফ পুরোপুরি গলে গেলে পৃথিবীর সবক’টি মহাসাগর ও সমুদ্রের জল-স্তর ৫৮ মিটার বা ১৯০ ফুটেরও বেশি উঠে আসবে। ফলে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বহু শহর, জনপদ, হারিয়ে যাবে বহু দেশ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে, তলিয়ে যেতে সময় লাগবে না অনেক মহাদেশেরও বড় অংশের।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, মহাসাগর লাগোয়া পৃথিবীর এই বৃহত্তম বরফের চাঙড়টির গলন উদ্বেগজনক ভাবে শুরু হতে হয়তো আর খুব দেরি হবে না। তার ফলে, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শেষ ভাগ পর্যন্ত মহাসাগর, সমুদ্রগুলির জল-স্তর উঠে আসতে পারে কম করে ৩ কি ৪ ফুট। তা উঠে আসতে পারে ৭ থেকে ১০ ফুটও। জলের তলায় তলিয়ে যেতে পারে ভারত, আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বহু শহর।
একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে তাঁদের সদ্য প্রকাশিত গবেষণাপত্রে। সেই দলে রয়েছেন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আর্থ সায়েন্সের গবেষকরা। রয়েছেন ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী, গবেষকরাও।
কী ভাবে এই পূর্বাভাস দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা? সামনের দিনগুলিতে কী হতে পারে সেই ধারণায় পৌঁছতে বিজ্ঞানীরা সময়ের হিসাবে অনেক পিছনে হেঁটেছেন। দেখেছেন, ২ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে ২ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা কেমন ছিল? তখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ছিল কতটা পরিমাণে?
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, খুব দ্রুত শিল্প আর প্রযুক্তির উন্নতি ঘটাতে গিয়ে, প্রকৃতির ভাঁড়ারে থাকা অপরিশোধিত তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের অপ-ব্যবহারের দরুন এখন পৃথিবীর বাতাসে আমরা যে পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস জমা করেছি, ২ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে ২ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগেও আমাদের গ্রহের বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল ঠিক ততটাই। তার কারণটা অবশ্য ছিল ভিন্ন। পৃথিবীর গা তখন পুড়ে যাচ্ছে সৌরকিরণে। বয়সে সূর্য তখন তরুণ। ফলে, ওই সময়েও ইস্ট অ্যান্টার্কটিকার এই বরফের চাঙড়টি গলে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে।
পরে, আজ থেকে ২ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে থেকে যখন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে শুরু করে পৃথিবী, তখন আবার বরফ জমে গায়েগতরে বাড়িয়ে তোলে পৃথিবীর বৃহত্তম এই বরফের চাঙড়টিকে। তাকে আর সে ভাবে গলতে দেয়নি এত দিন।
এই বরফের চাঙড়টি পরে আর না গলার আরও একটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। দেখেছেন, উত্তর গোলার্ধে বড় বড় বরফের চাঙড় তৈরি হওয়ার ফলে মহাসাগর, সমুদ্রগুলির জল-স্তর নেমে যায়। তার ফলে, মহাসাগর, সমুদ্রগুলি এত দিন উষ্ণায়নের দৌলতে অনেক বেশি গরম হয়ে উঠলেও ইস্ট অ্যান্টার্কটিক আইস শিটে সেই উষ্ণতার ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু এখন উত্তর গোলার্ধের বড় বড় বরফের চাঙড়গুলি যে ভাবে গলতে শুরু করেছে তাতে মহাসাগর আর সমুদ্রের জল-স্তর এই শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই উঠে আসবে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের। সে ক্ষেত্রে সমুদ্রের জলের সেই উষ্ণতার ছোঁয়াচ বাঁচানোটা ইস্ট অ্যান্টার্কটিক আইস শিটের সমুদ্র-লাগোয়া অংশের পক্ষে আর সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।