বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) ১০ কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির ফাইল দুদকে। এদের মধ্যে রয়েছেন মহাব্যবস্থাপক (জিএম), উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও ব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
১০ কর্মকর্তার সবাই বাপেক্সের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) পদে কর্মরত ছিলেন। অনেকে এখনো কাজ করছেন। ইতোমধ্যে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ দুদক কার্যালয়ে ডেকে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
এসব প্রকল্পের অন্যতম বড় ঠিকাদার আর্নিব এন্টারপ্রাইজের যাবতীয় ফাইল তলব করবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ওপর কোনো অডিট বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়ে থাকলে তা দুদকের কাছে হস্তান্তরের জন্য বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পগুলোর ভৌত এবং আর্থিক অগ্রগতিসংক্রান্ত তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল এসব রেকর্ডপত্র দেওয়ার কথা ছিল।
বাপেক্সের এ ১০ কর্মকর্তা হলেন-রূপকল্প-৩ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান, ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডিজিএম মেহেরুল হাসান, দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের প্রকল্প পরিচালক ডিজিএম সাবিহা আকতার খানম, রূপকল্প-১ এর প্রকল্প পরিচালক ডিজিএম মিজানুর রহমান চৌধুরী, রূপকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক ডিজিএম জহুরুল ইসলাম, রূপকল্প-৪ এর প্রকল্প পরিচালক বজলুর রহমান, ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের (ব্লক ৩বি, ৬বি ও ৭) প্রকল্প পরিচালক ডিজিএম মইনুল হোসেন ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালক আব্দুর রউফ। ব্যবস্থাপকদের মধ্যে রয়েছেন-রূপকল্প-৫ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তোফায়েল আহমেদ সিকদার ও রূপকল্প-৯ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তরিকুল ইসলাম।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, বাপেক্সে কোনো ধরনের দুর্নীতির ঠাঁই নেই। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই কেউ যদি দুর্নীতি কিংবা অনিয়ম করেন তাদের শাস্তি পেতে হবে। দুদক তার নিয়মে কাজ করবে। এছাড়া সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরাও বিভাগীয় তদন্ত করে থাকি। উল্লিখিত প্রকল্পগুলোতে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কিনা এটা তিনি বলতে পারছেন না বলে জানান।
দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম সম্প্রতি অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তার অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকে বিনা টেন্ডারে বারবার একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ডিজিএম মেহেরুল হাসানের বিরুদ্ধে। তিনি টেন্ডার ছাড়াই আর্নিব এন্টারপ্রাইজকে বিপুল অঙ্কের টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন এবং সেই কাজে অনিয়ম হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
ডিজিএম মেহেরুল হাসান ও আর্নিব এন্টারপ্রাইজ মিলে ২৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকায় ৯টি স্থানে জরিপ করেছে। এ জায়গাগুলোর মধ্যে কোনোটি বড় আবার কোনোটি অনেক ছোট।
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন, আর্নিব এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মেহেরুল বাপেক্সে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেওয়া, শ্রমিক নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে ২৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার সিন্ডিকেট। যা বাপেক্সের ঊর্ধ্বতনদেরও রীতিমতো বিপাকে ফেলেছে। তার বিরুদ্ধে আনা এ অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করেছে বাপেক্স।
বাপেক্স বলছে, বিনা টেন্ডারে ত্রি-মাত্রিক ভূ-কম্পন জরিপের কাজ করেছে একটি কোম্পানি। প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে তদন্ত কমিটি। সারা বছর ৯টি স্থানে দৈনিক ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করেছেন বলে দাবি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের। এমনকি ৯টি জরিপেই সমপরিমাণ যানবাহনের ব্যবহার দেখিয়েছে তারা। আর এসব তথ্য বাস্তবসম্মত মনে করে না বাপেক্সের তদন্ত কমিটি ও দুদক।
বিনা টেন্ডারে দেওয়া কাজে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নিচ্ছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
২৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজ করেছে বাপেক্স। এর ৯১ ভাগের কাজ শেষ হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাকি ৯ ভাগের জন্য বরাদ্দ ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ হিসাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সার্বক্ষণিক কর্মরত জনবল ছিল ১২০০ জন। এতে জনবল বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। আর যানবাহনের ব্যয় দেখিয়েছে ৮০ কোটি টাকা। তবে জরিপ এলাকাগুলোর মধ্যে ১৫০, ২০০, ৩০০ ও ৬০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাও ছিল। সেখানেও একই শ্রমিক ও একই পরিমাণ যানবাহন দেখানো হয়েছে।
প্রকল্পে নিয়ম না মেনে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রথম ধাপে ২ কোটি ৮০ লাখ ও দ্বিতীয় ধাপে ১৪ কোটি ৮ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও সেগুলো এখনও আসেনি। এছাড়া, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৫৮ কোটি ৫০ লাখ এবং ১৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা।