‘জয় বাংলা’র সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত : শাহাবুদ্দিন আহমেদমুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ চিত্রকর্মে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যরীতির সম্মিলন ঘটিয়ে নতুন ধরনের একটি রীতি নিয়ে আসেন, যা তাকে ইউরোপীয় চিত্র প্রেমিকদের মাঝে অনন্য করে তোলে। চিত্রকর্মে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্যারিসে বসবাসরত বাংলাদেশি এই চিত্রশিল্পীকে ‘নাইট’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে ফরাসি সরকার। তার ছবিতে বরাবরই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ আর বীরত্ব বিশেষ র্মযাদায় প্রতিফলিত হয়। ১৯৯২ সালে বিশ্বের পঞ্চাশ জন মাস্টার পেইন্টারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন শাহাবুদ্দিন আহমেদ।
কেমন আছেন?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : ভালো না থাকার কোনো উপায় নেই। প্রদর্শনী নিয়ে ব্যস্ত আছি, তারপরেও অনেক দিন পর কিছু চিত্রশিল্পী-বন্ধুদের কাছে পেয়েছি তাদের সঙ্গে আড্ডা দেবো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চিত্রকলার চর্চা ব্যাপক বেড়েছে। আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে চিত্রকলা এখন কেমন হচ্ছে?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : এই দেশে নাচ, গান, নাটক, কবিতা- কত কিছুই না হচ্ছে। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সংস্কৃতির এই স্রোতধারাটি আমাকে ভীষণ অবাক করে। আলোড়িত করে। বর্তমানে দেশের চিত্রকলা যে অবস্থানে এসেছে তা অকল্পনীয়। এদেশে অগণিত শিল্পী চিত্রকর্ম চর্চা করছে। তবে এটাকে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের চিত্রকলার মধ্যে কোনো তফাৎ পান কি?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : প্যারিসের সৌন্দর্যের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক কিছুর মিল খুঁজে পাই। তবে সেখানে মৌলিক কাজের চেয়ে বাণিজ্যিক ধারার কাজ হয় বেশি। সংখ্যার বিচারে ৯৫ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ কাজ অনবদ্য। মনে দাগ কাটার মতো। যেমন বলতে পারি- সেখানে অনেক শিল্পীই আছেন যারা তাদের দেশের নেতাদের ছবি আঁকেন। কিন্তু সেই সব ছবি মনে দাগ কাটে না বা কাটতে সক্ষম হয় না। তার কারণ ওই শিল্পীরা যাদের ছবি আঁকেন তারা কেউ সেই অর্থে ‘মহান’ কেউ নন। আমি যে সব ছবি আঁকি বা যাদের ছবি আঁকি তারা আমার কাছে মহান তো বটেই, তাবৎ দুনিয়াতেও। যেমন- বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী। চিত্রকর্মে রঙ-ই হচ্ছে একটি ছবির জীবন। তবে রংঙের ব্যবহারটা জানতে হবে। বাংলাদেশের রঙের ব্যবহার খুব বেশি। প্যারিসেও। তবে সেখানে ভিন্নতা রয়েছে। এ কারণে প্যারিসকে চিত্রকলার মক্কা বলা হয়।
আপনার বেশিরভাগ চিত্রকর্মের মুক্তিযুদ্ধের মেলবন্ধন রয়েছে। এর পেছনে নির্দিষ্ট কোনও কারণ আছে কি?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : ১৯৭১ সালে আমার শিল্পী সত্তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সত্তা এক হয়ে গিয়েছিল। এত বছর পরও সেই সত্তাকে লালন করে যাচ্ছি। আমার শিল্পকর্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমার কাছে ছবির প্রেম বড়ই বিচিত্র ও পবিত্র। ছবি এমনভাবে আমাকে অস্থির করে তুলেছিল, যে মুক্তিযুদ্ধ যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তবু আমি ছবি আঁকব। ফলে রণক্ষেত্রে থেকেও আমি জঙ্গলের মধ্যে ছবি এঁকেছি। প্রর্দশনী করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সকল মুখস্মৃতি আজও আমার ক্যানভাসে ঘুরেফিরে উঠে আসে।
যুদ্ধ পরবর্তী আপনার চিত্রকলা চর্চা সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : দেশ স্বাধীন হলো। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র। আবার নিবিড় হয়ে গেলাম ছবি আঁকা নিয়ে। প্রতিদিন সকালে জলরঙ আর কাগজ-বোর্ড নিয়ে হাজির হতাম চারুকলায়। তখন চারুকলার নাম ছিল চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। জাদুঘরের দক্ষিণ কোণ ঘেঁষে ছিল পরিত্যক্ত আস্তাবলের জায়গা। চারুকলায় এখন যেখানে মৃৎশিল্প বিভাগ হয়েছে ওখানে ছিল ঝোঁপ-জঙ্গল। জলরঙ করার জন্য ওটা ছিল আমার পছন্দের জায়গা। সকালে সূর্যের আলোর তেজ বাড়ার আগেই চার-পাঁচটি জলরঙ ছবি এঁকে ফেলতাম। তারপর ক্লাস করতাম।
শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্রকর্ম মানেই বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার সখ্যতা হলো কিভাবে?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : আমার কাছে বঙ্গবন্ধু এক বিশাল মাপের মানুষ। তিনি এক মহান নেতা। মহান বলে তার ছবির আঁকতে আমি ভালোবাসি। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দর্শন আমাকে প্রথম থেকেই আলোড়িত করেছিল। নানা সময়ে ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক। জাতির জনককে হৃদয়ে ধারণ করা খুব কঠিন। আমি গত পঞ্চাশ বছর ধরে এ চেতনা বহন করে চলেছি। এ পথ খুব কঠিন পথ। পৃথিবীকে ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছে। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন এদের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে। নতুন আশার পথ দেখিয়েছিলেন। এটা আজকের তরুণদের ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। কেননা পৃথিবীজুড়ে বিরাজ করছে সহিংসতা, অশান্তি। বিশ্বের কোথাও মানুষ নিরাপদ নয়। একমাত্র ভালোবাসাই পারে সেই নিরাপত্তা দিতে। বঙ্গবন্ধুর কারণে বাংলাদেশ পেয়েছি। তারপরেও বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছে। আমি আমার ছবিতে সেই কথা বারবার বলি। আমি হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে তার ছবি আঁকি
প্যারিসে আপনার প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রসঙ্গে কিছু বলুন। সেই যাত্রা কেমন ছিল?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। ছোটবেলা থেকেই শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখেছি। প্যারিসে গিয়ে টিকে থাকা সহজ ছিল না। আর দশটা দেশের শিল্পীর মত আমিও সেখানে হারিয়ে যেতে বসেছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা আমাকে সেখানে বিদ্রোহ করতে শিখিয়েছে। আমি সেখানে উঠে দাঁড়িয়েছি। বারবার অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চারুকলায় বিএফএ ডিগ্রি নিয়েও সেখানে গিয়ে ছবি এঁকে তবেই ভর্তি হতে হয়েছে। আবার ভর্তির পরও ছবি আকার সময় অনেকের ঈর্ষার শিকার হয়েছি। এরপর ১৯৮২ সালে প্রথম প্রদর্শনী করি। সেখানেও কয়েকজন ফরাসি নাগরিকের বাজে মন্তব্য শুনতে হয়েছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। আমার শিল্পীজীবন নিয়ে যারা একসময় অবহেলা করেছিলেন তারাই আবার একদিন এসে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমি আজকের এই অবস্থানে এসেছি। তবে আমি নিজেকে কখনোই বড় শিল্পী মনে করি না। বাংলাদেশের শিল্পীদের জন্য শিল্পের জন্য আমি আমার মতো করে সাধ্যমতো করার চেষ্টা করছি। প্যারিসে গিয়ে আমি কত কী না চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের শিল্পকলা নিয়ে প্যারিসে আজ অবধি যা কিছু ঘটেছে আমার মাধ্যমেই হয়েছে। অনেকে অনেক কথাই হয়তো বলবেন কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। অনেকে অনেকভাবেই নাম কিনেছেন। ফ্রান্সে বাংলাদেশে যত চিত্র প্রর্দশনী হয়েছে আমার মাধ্যমেই হয়েছে। আমি চাইলে একটা দূরত্ব তৈরি করে একটা ভিন্ন অবস্থানে থাকতে পারতাম। কিন্তু তা করেনি।
এদেশের নতুন চিত্রকরদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : নতুন চিত্রকরদের বলবো সারাক্ষণ ছবি আঁকলেই হবে না। সবার আগে ধারণ করতে হবে দেশের চেতনাকে। আঁকলেই যে শিল্পী হয়ে গেলাম, এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। প্রকৃত শিল্পী হয়ে উঠতে হলে সাধনা লাগে। সঙ্গে থাকতে হয় সাহস আর মনোবল। ভেতরের সাহসটাকে জয় করে তবেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে হবে।
সাধনার বিকল্প নেই। তবে সাধনাতেও সবসময় কাজ হয় না। সঙ্গে নিজস্ব গুণাবলী থাকতে হবে। এটা ঈশ্বর প্রদত্ত বিষয়। ‘সৃষ্টি’ কথাটা আমার কাছে খুবই বিপদজনক শব্দ। এটা কারও জীবনে একবারই ঘটে। আবার কারও জীবনের একবারও হয় না। যেমন ধরো- কেউ একজন ৫০ বছর ধরে কবিতা লিখেই যাচ্ছে। সেটা ভালো হচ্ছে কি খারাপ হচ্ছে তার বিচারে যাবো না কিন্তু সে তো একটা কিছু সৃষ্টির জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এটাই তো বড় কথা। এর মধ্যে যদি ‘কিছু একটা হয়ে যায়’ সেটাই হচ্ছে প্রকৃত সৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে তার পরিশ্রমকেও মূল্যায়ণ করতে হবে। একাগ্র মনে সাধনা করে গেলে সৃষ্টি নিজের কাছে ধরা দেবে। সৃষ্টির পেছনে ছুটতে হবে না।
এখনকার প্রজন্ম খুব শক্তিশালী। তাদের মধ্যে আগুন রয়েছে। তা না হলে শাহবাগ কেনো হবে। এই তরুণরাই তো আগামী দিনের জয়বাংলা ও বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
আপনার ক্যানভাসে রাজনৈতিক একটা ছোঁয়া থাকে, কেন?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি আঁকি বলে কেউ কেউ একে রাজনৈতিক ছবি বলেন। কিন্তু আমি বলবো, আমি কখনও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কোনো ছবি আঁকি না। আমি যেটা বিশ্বাস করি, সেটাই প্রকাশ করি চিত্রকর্মে। অন্তর থেকে ছবি আঁকি। বঙ্গবন্ধুকে আমি কখনও আওয়ামী লীগের নেতা ভাবিনি। তাকে কাছ থেকে দেখে এবং ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। সেই প্রেক্ষাপটে আমাকে রাজনৈতিক শিল্পী বললে আমার কিছু করার নেই। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলতে পারি। ১৯৭৩ সালে ক্যাবিনেট মিটিং চলছিল। সেখানে আমার আঁকা ‘প্রিজনার’ ছবি নিয়ে হাজির হই। বঙ্গবন্ধু ছবিটি দেখে বললেন, আমি ছবি খুব ভালো বুঝি না। কিন্তু ছবিটা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারাজীবন তো জেলেই কাটালাম।
আপনার এবারের প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘শান্তি’। এই নাম কেনো রাখলেন?
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : বিশ্বে যা কিছু হচ্ছে তা শান্তির জন্য। তবে এখন বিশ্বে শান্তির ভীষণ অভাব। যন্ত্র-দানব দিয়ে শান্তি আনা সম্ভব নয়। যন্ত্রকে সঙ্গী করে অতীতে কেউ শান্তি আনতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। শান্তি আনা যায় না, অর্জন করতে হবে। ভেতর থেকে শান্তি আসে। বুলেট থেকে নয়। এই জন্য প্রদর্শনীর নাম দিয়েছি ‘শান্তি’। ‘শান্তি’ শব্দটা এখন প্রচলিত। তবে এটা অন্য নামে ব্যবহার হতো। যেমন মহাত্মা গান্ধী অহিংসা আন্দোলন করেছিলেন শান্তির জন্য।
এবার ‘জয় বাংলা ’ স্লোগান নিয়ে কিছু জানতে চাই।
শাহাবুদ্দিন আহমেদ : ‘জয় বাংলা’র সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত। যুদ্ধ চলাকালীন, যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে এমন কেউ নেই যে জয় বাংলা বলেননি। ‘জয় বাংলা আমার শিল্পী সত্বার মূলমন্ত্র।