মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি।
সু চি ও তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) জ্যেষ্ঠ নেতাদের দেশটির সেনাবাহিনী গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মাথায় জনবিক্ষোভের ডাক দেন এনএলডির এই নেত্রী। তাঁর নামে প্রচারিত এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের জনগণকে বিক্ষোভ দেখানোর আহ্বান জানানো হয়।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চির সরকার উৎখাত করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তারা দেশটির ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
সু চি বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটিতে আবার জান্তা শাসন কায়েম করার চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গ তিনি বলেন, ‘এটি মেনে না নেওয়ার জন্য আমি জনগণের কাছ অনুরোধ জানাই।’
মিয়ানমারের জনগণকে উদ্দেশ করে সু চি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ঐকান্তিক প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানাই।’
সু চির বিক্ষোভের ডাকে দেশটির অনেক মানুষ সাড়া দেবেন বলে মনে করেন মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিসন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের জনগণ ফের পুরোপুরি জান্তা শাসনে ফিরতে চাইবেন না।
দেশটির সামরিক টেলিভিশনে আজ সোমবার সকালে ঘোষণা করা হয় যে সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে। তারা এক বছরের জন্য মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। গত বছরের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির জন্য তারা বেসামরিক সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে।
সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে টেলিফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা বাধাগ্রস্ত করছে দেশটির সামরিক কর্তৃপক্ষ। দেশটির রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। তারা জানিয়েছে, কারিগরি কারণে সম্প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশজুড়ে ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের জেরে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব নেতৃত্ববৃন্দ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এই অভ্যুত্থানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার যেকোনো ধরনের চেষ্টার বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টারও বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটলে মিয়ানমারের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে।
মিয়ানমারের নেত্রী সু চিসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশটির গণতান্ত্রিক সংস্কারের ওপর মারাত্মক আঘাত।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারে বলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে উদ্বেগ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। আজ সকালে এনএলডির মুখপাত্র মিও নয়েন্ট বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, দলীয় নেত্রী সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্তসহ দলের অন্য নেতাদের ভোরে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। পরে সেনাবাহিনীই সু চির সরকার উৎখাতের ঘোষণা দেয়।
গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচন সু চির দল বিপুল জয় পায়। কিন্তু দেশটির ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনী এই নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তোলে।
সু চির দল নির্বাচনে ৪৭৬টির মধ্যে ৩৯৬টি আসনে জয় পায়। অন্যদিকে, সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পায় মাত্র ৩৩টি আসন। এই জয়ের মধ্য দিয়ে সু চির দল আরেক দফায় পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসনের ম্যান্ডেড পায়।
গণতন্ত্রের জন্য জান্তা শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেন সু চি। এ জন্য তাঁকে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকতে হয়। তিনি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পান। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পান।
২০১৫ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত প্রথম অবাধ নির্বাচনে সু চির এনএলডি বিপুল জয় পায়। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ক্ষমতায় বসে এনএলডি। তাঁর সরকারের সময়েই মিয়ানমারের রাখাইনে নারকীয় দমন-পীড়নের শিকার হয় রোহিঙ্গারা। লাখো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গা গণহত্যায় নিষ্ক্রয় ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক দুর্নাম কুড়ান সু চি।