তোফায়েল আহমেদ
প্রতিবছর যখন ১৭ মার্চ আসে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা কত স্মৃতি মনের চারপাশে ভীড় করে। এমন মহামানবের সান্নিধ্য কেঁদেও আর পাবো না কোনদিন, এমনটা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়। মনে পড়ে ’৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। সারাদেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবন অর্থাত্ পুরাতন গণভবন সুগন্ধা থেকে দুপুরে যখন তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ফিরে এলেন তখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না— আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উত্সর্গ করেছি।’ কত বিশাল হূদয়ের মহত্ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই তিনি জনগণের জন্য উত্সর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌড়ে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। ধানমন্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় তখন ভালো একটি প্লট নেয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, ‘আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।’
বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে সারাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ সফর করেছি। তিনি অন্তরে যা বিশ্বাস করতেন দেশের মানুষকে তা-ই বলতেন। একবার যা অঙ্গীকার করতেন জীবন দিয়ে হলেও তা বাস্তবায়ন করতেন। এজন্যই দেশের মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করতো। শুধু দেশের মানুষ নয়, বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কগণ বঙ্গবন্ধুকে অপরিসীম শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। যেখানেই গিয়েছেন মানুষ তাঁকে আপন করে নিয়েছে। তত্কালের সব বরেণ্য নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে— সোভিয়েট ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পোদগর্নি, প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল জোসেফ ব্রোঞ্জ টিটো, ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান শ্রী ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিথ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হুয়ারে বুমেদীন, তাঞ্জানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান জুলিয়াস নায়ারে, গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিথ, কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মালয়েশিয়ার টুঙ্কু আবদুর রাজ্জাক, জাম্বিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কেনেথ কাউন্ডা— প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুকে অশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সফর করেছি জ্যামাইকার কিংস্টনে। কাছ থেকে দেখেছি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কতোটা সম্মান করতেন বঙ্গবন্ধুকে। বিশেষভাবে মনে পড়ে ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধিদলের সদস্যবৃন্দ বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য। নিজ চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভবপর নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। আমার মনে পড়ে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যগণ আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছো, যিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা নন—এশিয়ার নেতা নন; তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’
মনে পড়ে ’৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহত্ গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমাকে আমি যা না তার চেয়ে অনেক বড় করে তুলে ধরে তিনি তাঁর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এবং বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন তখন সে এলাকার সংগঠক বা নেতা-কর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে টেনে তুলে উন্নীত করেছিলেন জাতীয় নেতায়। ফলে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে আজো বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে।
’৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখের কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরো বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি— কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
বঙ্গবন্ধুর কথা এবং বক্তৃতায় প্রায় সময়-ই উদ্ধৃত হতো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের কবিতার চরণ। এতো সাবলীল আর প্রাসঙ্গিকতায় তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতে হতো। মনে পড়ে ’৭১-এর রক্তঝরা মধ্য মার্চের কথা। যখন ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা চলছে তখন বিদেশী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নজরুলের কবিতা থেকে তরজমা করে বলতেন, I can smile even in hell; কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে বলতেন, ‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ সেসময় অগ্নিঝরা মার্চে একদিকে চলছে আলোচনার নামে ইয়াহিয়ার প্রহসন, অন্যদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কাজ পুর্নোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিল নেতার অভয় মন্ত্র। এই মার্চেই টঙ্গীতে পাক সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল ভয়াল গর্জনে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। উত্তেজিত শ্রমিক শ্রেণির উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান শেষে বিদ্রোহী কবিকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না…।’ ২৫ মার্চের থমথমে দিনটিতে গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে সাংবাদিক সাক্ষাত্কারে বিষাদাচ্ছন্ন স্বরে বলেছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়…।’ আশ্চর্য রকম অবলীলায় পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে তিনি এসব কাব্যাংশ উচ্চারণ করে যেতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি তো সব সময় বলতেন, এমনকি দু’ দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও
তিনি বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হূদয়ের যে দরদ যে ভালোবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়।
নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করতো। একবার এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে— আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।’ নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। তা প্রতিফলিত হয়েছে, অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’
’৭৫-এর জানুয়ারির ১১ তারিখের কথা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো জ্বলজ্বল করে। হূদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। এদিন বাংলাদেশ সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘…আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন, প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন। কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দু’বার হন না। জাতির পিতা হিসাবেই যে আমি তোমাদের ভালোবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সত্ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে। মনে রেখো তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী।’ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির জনক যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিনি ‘জনগণের বাহিনী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনা সদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সত্ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন, ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’
অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতা-কর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হূদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। ’৭২-এর ১৪ এপ্রিল, আমি তখন গ্যাস্ট্রিক-আলসারে আক্রান্ত হয়ে হলিফ্যামিলিতে চিকিত্সাধীন। আমার পাকস্থলীতে নালী-ঘায়ের অপারেশন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে এসেছেন। সস্নেহে আমার হাত ধরে, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। আমার একমাত্র কন্যা মুন্নী যখন ২য় শ্রেণিতে পড়ে তখন টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে স্নেহাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালোবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। ফটোগ্রাফার অনেকেই প্রশ্ন করতেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি এতো ছবি তোলেন কেন?’ বলতেন, ‘ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।’ বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দুটি গাড়ি থাকতো। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তো। তখন এরকম স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ানো হঠাত্ একটি শিশু কত বয়স হবে সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘স্লামুআলাইকুম, মুজিব সাহেব!’ তত্ক্ষণাত্ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি একজন রাষ্ট্রনায়কের শিশুদের প্রতি কী অপার ভালোবাসা, কী অপূর্ব মমত্ববোধ। আর এজন্যই আমরা জাতির পিতার জন্মদিনটিকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় আমরা সকলেই গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিলাম; অচেতন থেকে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলাম যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের। দীর্ঘ নয় মাস চৌদ্দ দিন কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বকালের সর্ববৃহত্ ঐতিহাসিক গণমহাসমুদ্রে তিনি বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্চকিত হয়েছিলেন এই বলে যে, ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছো, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে…।’
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। আকাশের মতো উদার ছিল তাঁর হূদয়। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে সমসাময়িক নেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের তাঁর তেজোময় ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন ভাস্বর। তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তাঁর একটা তহবিল থাকতো আমার কাছে। এই তহবিল থেকে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের প্রতিপক্ষীয় লোকজনও ছিলেন। কিন্তু শর্ত ছিল যাদেরকে অর্থ সাহায্য দেয়া হচ্ছে তাঁদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে, প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত, কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। সময়ের এক চুল হেরফের হতো না, ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানাদিতে যেতেন। দলের নেতা-কর্মী সকলের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাদের কাজের মর্যাদা দিতেন, ভালোবেসে বুকে টেনে নিতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। ’৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন শ্রদ্ধাভাজন জননেতা শহীদ কামারুজ্জামান সাহেব। আবার ’৫৭তে করেছিলেন বিপরীত কাজটি অর্থাত্ মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না। বজ্রকণ্ঠের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয় বাগ্মী। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বক্তৃতায় বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি চয়ন যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। যেজন্য তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো।