সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে সংক্রমণের হার কমতে পারে। দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে দুই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল। দুটি পূর্বাভাসেই বলা হয়েছে, মহামারি পরিস্থিতি পর্যালোচনায় চারজনের ওই কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটিকে তথ্য বিশ্লেষণে সহযোগিতা করছে। দলটির দেওয়া পূর্বাভাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত এপ্রিল থেকে ব্যবহার করে আসছে। তারা সর্বশেষ পূর্বাভাস দিয়েছে ২৩ জুন।
দুটি পৃথক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি দুই পূর্বাভাসে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যায় তফাত রয়েছে। প্রথম পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, এখন সংক্রমণ পরিস্থিতি চূড়ান্ত পর্যায়ের কাছাকাছি। জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণ পরিস্থিতি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার আশঙ্কা আছে। আগস্টের শেষের দিকে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজার ছাড়াতে পারে। মৃত্যু হতে পারে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষের।
দ্বিতীয় পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হতে পারে জুলাইয়ের মাঝামাঝি। আগস্টের শেষের দিকে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪ লাখ ৩৯ হাজার ছাড়াতে পারে। মৃত্যু হতে পারে প্রায় ছয় হাজার মানুষের।
পূর্বাভাসের বিষয়টি গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশে করোনা: ছয় মাসের পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানেও উঠে আসে। সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম পূর্বাভাসের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। পবিত্র ঈদুল আজহার সময় মানুষের চলাচলে কড়াকড়ি ব্যবস্থা না নিলে পরে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। বিভিন্ন ল্যাবরেটরির তথ্য এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে করোনা সংক্রমণের হার ১ দশমিক শূন্য ৫।
একজন করোনা রোগীর মাধ্যমে কতজন সংক্রমিত হন, সেটাই সংক্রমণ হার বা ইফেকটিভ রিপ্রোডাকশন রেট (আরটি)। আরটি ১–এর বেশি থাকার অর্থ সংক্রমণ পরিস্থিতি বিপজ্জনক পর্যায়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথম পূর্বাভাসের তথ্য জানালেও দ্বিতীয়টির কথা উল্লেখ করে না। কেন উল্লেখ করা হয় না, তা নিয়ে অধিদপ্তরের কারও কাছ থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
কারিগরি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শাফিউন শিমুল বলেন, ‘দুটি পূর্বাভাসের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তুলনামূলক কম মৃত্যু এবং কম সংক্রমণের পূর্বাভাসটি ব্যবহার করেন।’
কারিগরি দলের সদস্যরা বলছেন, প্রক্ষেপণ বা পূর্বাভাসের জন্য যে মানের তথ্য ও উপাত্ত দরকার হয়, তা তাঁরা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে প্রক্ষেপণ করা হয়। শর্তগুলো বদলে যাওয়ায় পূর্বাভাস মেলে না। এই দলে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সৈয়দ আব্দুল হামিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল এবং কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোফাক্কার হোসেন।
সংক্রমণ পরিস্থিতির পূর্বাভাসের একটি মডেল হচ্ছে এসআইআর (সাসেপটিবল, ইনফেক্টেড, রিমুভড)। এতে মূলত রোগতাত্ত্বিক তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করে প্রক্ষেপণ করা হয়। অন্যটিকে বলা হয় টাইম সিরিজ মডেল। অর্থনীতিবিদ ও ডেটাবিজ্ঞানীরা এটা বেশি ব্যবহার করেন। কারিগরি দল প্রথম প্রক্ষেপণ দিয়েছে এসআইআর মডেলে ও দ্বিতীয়টি টাইস সিরিজ মডেলে।
অবশ্য শাফিউন শিমুল বলেন, ‘আমার মনে হয়, বাস্তবতা সম্ভবত দুটি প্রক্ষেপণের মাঝামাঝি কোথাও। এ মাসের শুরুতে এসআইআর মডেল ব্যবহার করে বলেছিলাম, ৩০ জুনে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ১ লাখ ২৩ হাজার। অন্য মডেলে বলেছিলাম ১ লাখ ৬৩ হাজার। এখন আক্রান্তের সংখ্যা দুটোর মাঝামাঝি।’
গতকাল পর্যন্ত দেশে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৪৭৪ জন।
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আটজন বিশেষজ্ঞ করোনা পরিস্থিতির পূর্বাভাসে বলেছিলেন, মে মাসের শেষ নাগাদ দেশে ৪৮ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। গতকাল বিশেষজ্ঞ দলের একাধিক সদস্য বলেছেন, লকডাউন চালু থাকবে, পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য কলকারখানা বন্ধ থাকবে, মানুষ মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানবে, এসব শর্তপূরণ সাপেক্ষে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব শর্ত পূরণ হয়নি। তাই পূর্বাভাস মেলেনি। মানসম্পন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে বাস্তব পরিস্থিতির কাছাকাছি চিত্র পাওয়া সম্ভব।
সর্বশেষ প্রক্ষেপণ
এপ্রিল মাস থেকে কারিগরি দল প্রতি সপ্তাহে সরকারকে করোনার প্রক্ষেপণ দিচ্ছে। সর্বশেষ দিয়েছে ২৩ জুন। এসআইআর মডেল ব্যবহার করা প্রক্ষেপণে বলা হয়, দেশ এখন সংক্রমণের শীর্ষ পর্যায়ের কাছাকাছি। সংক্রমণ হার বা আরটি ১–এর বেশি। বর্তমান সংক্রমণ হার ১ দশমিক শূন্য ৫ এবং দৈনিক প্রায় ৪ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। এটা বিপজ্জনক সংকেত।
ওই প্রক্ষেপণে আরও বলা হয়েছে, সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকতে পারে জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে সংক্রমণ কমা শুরু হতে পারে। পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও তাতে বলা হয়েছে। ঈদের পরে আরেকটি ‘পিক’ (চূড়ান্ত পর্যায়) দেখা দিতে পারে। কারিগরি দল বলেছে, ইরান, সৌদি আরবে সংক্রমণ একাধিকবার চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠতে দেখা গেছে।
টাইম সিরিজ মডেলে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হতে পারে মধ্য জুলাই থেকে। তখন দৈনিক ৫ থেকে ৬ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে, যদি পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ে, তা হলেই শনাক্তের সংখ্যা ওই পর্যায়ে যেতে পারে।
শাফিউন শিমুল বলেন, ‘দুটো মডেলে সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সময়ের কিছু পার্থক্য আছে। আর শেষটিতে মোট সংক্রমণের পরিমাণও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। দুটো মডেলেই বলা হচ্ছে, সংক্রমণ কমা শুরু হতে পারে সেম্টেম্বর থেকে।’
এ বিষয়ে পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘রোগতাত্ত্বিক গাণিতিক হিসাবে অনুমান করা হচ্ছে, আগস্টের শেষ থেকে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যেতে পারে। তবে মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, কোরবানির ঈদের সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি ভেঙে পড়ে, তাহলে এই প্রক্ষেপণও কাজে আসবে না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’
ছয় মাসের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হতে পারে, সে সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি।
গতকাল বেলা ১১টা থেকে অনলাইনে জুমের মাধ্যমে সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হন। অনুষ্ঠানে গত ছয় মাসে সাংবাদিকেরা করোনা বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে কী দেখেছেন, তা তুলে ধরেন। মোটা দাগে ছয় খাতের পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিল: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন অধিদপ্তরগুলোতে নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের ঘাটতি আছে; মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিকল্পনা ঠিক ছিল না; জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণার দক্ষ জনবল ও অবকাঠামোর কমতি আছে; কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে; তথ্য–উপাত্ত ও পরিসংখ্যান তৈরি, সংরক্ষণ ও বিতরণে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের আরও আন্তরিক ও দক্ষ হওয়া দরকার এবং দেশি বিশেষজ্ঞদের সরকার ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সফল উদ্যোগ থেকে শিক্ষা নিতেও তারা দ্বিধা করেছে।
এসব ব্যাপারে অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সঠিক পরিকল্পনা বিশ্বের কোনো দেশই করতে পারেনি। সমন্বয় বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেনাকাটার অনিয়মের অভিযোগ দুদক তদন্ত করছে। সেই তদন্তে সহযোগিতা করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আবুল কালাম আজাদ জানান, চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি টিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা বাংলাদেশে হবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের কোন কোন প্রতিষ্ঠান টিকা বানাতে পারবে, তা–ও জানার চেষ্টা করছে সরকার।
সাংবাদিকদের ছয় দফা পর্যবেক্ষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, করোনা মোকাবিলায় সমন্বয়, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি—কিছুই ছিল না। তিনি বলেন, অনেক দুর্বৃত্ত পণ্য সরবরাহ করেছে। কিন্তু ক্রয়প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জড়িত ছিল কি না, তার তদন্ত হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ–ই–মাহবুব বলেন, সরকারকে আরও দৃঢ় হতে হবে, যাতে মহামারি নিয়ে কেউ ব্যবসা করার সুযোগ না পায়।
মধ্যবর্তী মূল্যায়ন দরকার উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ বলেন, এখনো যাঁরা সংক্রমিত হননি তাঁদের রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো দরকার।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, স্বল্পতম সময়ে মানুষকে সচেতন করে কীভাবে করোনা মোকাবিলার কাজে সম্পৃক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালানো দরকার।