স্বাস্থ্য অধিদফতর জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকরে গাইডলাইন তৈরি করেছে ।মহানগর এলাকার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা সমীচীন হবে বলে মনে করছে সিটি করপোরেশন ও গাইডলাইন প্রণয়ন কমিটি।
তারা বলছেন, লাল বা হলুদ জোনের অফিস-আদালত পরিচালনা, কলকারখানা ব্যবস্থাপনা, দোকানপাট নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা বা বন্ধ রাখা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর হোম ডেলিভারি নিশ্চিত করা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চক্রে অনেক মন্ত্রণালয় ও দফতরের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই আইনগত এখতিয়ার সৃষ্টি এবং সমন্বিত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্বার্থে নির্দেশিকাটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি হওয়া সমীচীন হবে।
গাইডলাইন
কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি:
সিটি করপোরেশনের মেয়রকে সভাপতি করে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ১০ সদস্যের এ কমিটিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যরা উপদেষ্টা থাকবেন। কমিটির কর্মপরিধিতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিহ্নিত জোনসমূহ থেকে অগ্রাধিকার ও পারিপার্শ্বিক সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে জোন বা স্পট বাছাই করবে। নির্ধারিত জোন বা স্পটের লকডাউনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
জোন বা স্পট ব্যবস্থাপনা কমিটি:
৯ সদস্যদের এই কমিটিতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহ্বায়ক থাকবেন। কমিটির কার্যপরিধি হবে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা অনুসারে লকডাউন বাস্তবায়ন করা। লকডাউন কার্যকর করার স্বার্থে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা। জনসচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ানো এবং বিবেচ্য এলাকার নাগরিক সুবিধা অটুট রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
কমিটির সভা:
উল্লেখিত সব কমিটি প্রচলিত সভা পরিহার করে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করবে।
জোন চিহ্নিতকরণ:
এটুআই প্ল্যাটফর্ম কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জোন চিহ্নিত করবে।
মোবাইল অ্যালার্ট সার্ভিস:
কোনও ব্যক্তি যদি করোনাপ্রবণ এলাকায় অবস্থান করেন তাহলে মোবাইল অ্যালার্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হবে। এটুআই বা আইসিটি বিভাগ এটি বাস্তবায়ন করবে।
জোন রূপান্তর:
কোনও স্থান বা মহল্লায় লাল, হলুদ, সবুজ কিংবা সবুজ, হলুদ, লাল ধাপে রূপান্তর হলে জনসাধারণ অ্যাপ ব্যবহার করে পুশ অ্যালার্ট মেসেজের মাধ্যমে জানতে পারবে।
ফেসবুক, টেলিভিশন ও স্বাস্থ্য বুলেটিনে প্রচারণা:
লাল বা হলুদ জোনের আওতাভুক্ত এলাকা সম্পর্কে ফেসবুকে সতর্কীকরণ বার্তা বা পুশ ম্যাসেজ প্রেরণ ও টেলিভিশনে প্রচারণা চালানো সম্ভব হলে লকডাউন বাস্তবায়নে জনসম্পৃক্ততা অনেক বাড়বে। পাশাপাশি রেড জোন সম্পর্কে স্থানীয় মসজিদের মাইকে সতর্ক বার্তা প্রচার করা হলে লকডাউন বাস্তবায়ন অনেকাংশে সহজ হবে বলে গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, কারখানা, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প:
লাল জোনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কারখানা, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বন্ধ থাকবে। হলুদ জোনে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ৫০ শতাংশ কর্মী দিয়ে চালু রাখতে হবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে স্থানীয় আঞ্চলিক নির্বাহী অফিসার ও থানাকে অবহিত করতে হবে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা:
গাইডলাইনে বলা হয়েছে, লাল বা হলুদ জোন লকডাউন ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার স্বার্থে স্থানীয় কল্যাণ সমিতি, ক্লাব বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা একান্ত দরকার। জোন বা স্পট ব্যবস্থাপনা কমিটি এ কাজটি আবশ্যিকভাবে বাস্তবায়ন করবে। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অবহিত করে লকডাউন ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন ও তাদের পরামর্শে রাজনৈতিক প্রতিনিধি কমিটিতে রাখতে হবে।
নমুনা সংগ্রহ:
লাল জোন এলাকায় নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বুথ স্থাপন করতে হবে।
হোক কোয়ারেন্টিন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা:
লাল ও হলুদ জোন এলাকায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়োগকালী সংস্থা কঠোর ভূমিকা পালন করবে। এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর টহলও অব্যাহত থাকবে। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে।
আইসোলেশন কেন্দ্র:
স্থানীয়ভাবে আইসোলেশন কেন্দ্র স্থাপন সহজসাধ্য না হওয়ায় করোনা রোগীকে সরকার নির্ধারিত আইসোলেশন কেন্দ্রে রাখা সমীচীন হবে বলে গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
টেলিমেডিসিন সার্ভিস:
লকডাউন এলাকার কোভিড ও নন কোভিড রোগীরা যাতে টেলিফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারে সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর লাল ও হলুদ জোনের জন্য একটি ডক্টরস পুল প্রস্তুত করবে। এতে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা লকডাউন এলাকার রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ দেবেন। ডক্টরস পুলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভু্ক্ত করতে হবে।
মৃতদেহ সৎকার:
লকডাউন এলাকায় মৃতদেহ সৎকার ‘আল মারকাজুল ইসলামী’ বা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম’ বা এ কাজে নিয়োজিত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে দাফন বা সৎকার করা সমীচীন হবে বলে গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রোগী পরিবহন:
লকডাউন এলাকার কোনও ব্যক্তিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে আনার প্রয়োজন হলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের অনুমতি নিয়ে বাইরে আসতে পারবে। তবে কোনও রোগী পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স দরকার হলে ব্যক্তিগতভাবেই তা সংগ্রহ করতে হবে।
হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা:
গাইডলাইনে বলা হয়েছে, লকডাউন এলাকার কোনও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে ১৬২৬৩ বা ডক্টরস পুলে ফোন করা হলে রোগীকে কোন হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে সে বিষয়ে সহযোগিতা করা যেতে পারে।
মুদি দোকান বা ফার্মেসি:
রেড জোনে হোম ডেলিভারি এবং হলুদ ও সবুজ জোনে খোলা থাকবে।
রেস্তোরাঁ বা চা দোকান:
রেড জোনে হোম ডেলিভারি এবং হলুদ জোনে টেক আউট এবং সবুজ জোনে খোলা থাকবে।
বাজার:
লাল জোনে হোম ডেলিভারি, হলুদ জোনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দোকান খোলা থাকবে। সবুজ জোনেও খোলা থাকবে।
শপিং মল: সব জোনেই বন্ধ থাকবে।
গণপরিবহন:
লাল জোনে গণপরিবহন চলাচল করবে না। হলুদ জোনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারবে। আর একজন যাত্রী নিয়ে রিকশা বা অটোরিকশা চলতে পারবে। সবুজ জোনে সব চলাচল করবে।
মালবাহী যানবাহন:
লাল জোনে শুধু রাতে; হলুদ ও সবুজ জোনে দিনে রাতে চলতে পারবে।
মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান:
লাল জোনে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ, হলুদ ও সবুজ জোনে দূরত্ব এঁকে ব্যবহার করা যাবে।
জনসাধারণ চলাচল নিয়ন্ত্রণ:
লাল ও হলুদ জোনে মানুষের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করার লক্ষ্যে ভৌগোলিক বাস্তবতা অনুসরণ করে সড়ক, গলি, গলিমুখ ইত্যাদি বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া মহল্লার ভিতরে বা গলিতে জনসাধারণের অবাধ বিচরণ বা আড্ডা অবশ্যিকভাবে বন্ধ করতে হবে। স্বল্প এলাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মহল্লা কমিটি ও কল্যাণ সমিতিকে এ কাজে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কোনও শৈথিল্য প্রদর্শন করা হলে জোনিং সিস্টেম সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে।
হোম ডেলিভারি:
লাল বা হলুদ জোনে হাট-বাজার, মুদি দোকান, ফার্মেসি ইত্যাদি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। পাশাপাশি জনসাধাণের চলাচলও অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এ অবস্থায় এলাকার মানুষের বাসাবাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধপত্র নির্বিঘ্নে সরবরাহের জন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও হোম ডেলিভারি সার্ভিস সক্রিয় করা একান্ত দরকার। গাইডলাইনে স্বেচ্ছাসেবীদেরও এ কাজে নিয়োজিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বস্তিবাসী বা লকডাউনের কারণে কর্মহীনদের খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
লকডাউন এলাকার মধ্যে কোনও বস্তিবাসী থাকলে তাদের জন্য ২ সপ্তাহের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া উক্ত এলাকার মধ্যে কোনও নাগরিক আকস্মিক কর্মহীন হয়ে পড়লে তাকেও খাদ্য সহায়তার আওতায় আনতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সামাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিটি করপোরেশনে সংযুক্ত করা দরকার। এজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ জরুরি বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। আর কোনও ব্যক্তি ওএমএসসহ অন্য কোনও নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকলে এই ত্রাণ সহায়তা থেকে বাদ যাবেন।
মনিটরিং কমিটি:
সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠিত হবে। কমিটি ৫-৭ দিন পরপর লকডাউন এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় কমিটিকে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করবে।
গাইডলাইনে বলা হয়েছে, লাল বা হলুদ জোনের অফিস-আদালত পরিচালনা, কলকারখানা ব্যবস্থাপনা, দোকানপাট নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা বা বন্ধ রাখা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর হোম ডেলিভারি নিশ্চিত করা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বৃদ্ধি করা, এটিএম বুথ পরিচালনা, মসজিদ ব্যবস্থাপনাসহ এসব বিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চক্রে অনেক মন্ত্রণালয়, দফতর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সুতরাং আইনগত এখতিয়ার সৃষ্টি এবং সমন্বিত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্বার্থে এ নির্দেশিকাটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে জারি হওয়া সমীচীন হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. এমদাদুল হক বলেন, আমাদের নির্দেশনা সংবলিত কিছু কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কারও স্বাক্ষর নেই। আমরা বলেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের অফিসিয়ালি জানাতে হবে। নির্দেশ দিতে হবে যে তুমি এটা করো। তখন আমরা সেটা বাস্তবায়ন করবো। আর গাইডলাইন অনুযায়ীই আমাদের সব বাস্তবায়ন হবে।