The news is by your side.

অফুরান অনুপ্রেরণা শহীদ জননী শাহানারা আবদুল্লাহ

0 1,132

 

 

রাজু হাওলাদার পলাশ

“বিদায়ের সময় মানুষ বুঝতে পারে তার সত্যিকারের ভালবাসা” -খলিল জিবরান।

৫ জুন, ২০২০ চলে গেলেন শহীদ জননী শাহানারা আবদুল্লাহ। রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত তিনি ছিলেন আমরণ সংগ্রামী মানুষের এক অনবদ্য চরিত্র। তিনি সেই মহান নারীদের একজন ,যাদের অসাধারণ ত্যাগে একাত্তরের রণাঙ্গন শুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালের সম্মুখ সমরে বরিশালে মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থেকে মুক্তিযুদ্ধ নামক মহাকাব্য রচনায় অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন এই সাহসী নারী।

স্বামী রনাঙ্গনে, গর্ভে সন্তান, সামনে-পেছনে পাকিস্তানি হায়েনা সেনা আর রাজাকার, ধরা পড়লে নিশ্চিত মরণ। ভয়কে জয় করে শুধু দেশপ্রেমকেই অস্ত্র বানিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যা অকৃত্রিম দেশপ্রেম আর অসীম মনোবলের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই ঘোর অনিশ্চয়তার অন্ধকারেও একজন সন্তানসম্ভবা নারী কিভাবে সবকিছু উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন, তাদের জন্য অর্থ, খাবার, পোশাক সংগ্রহ ও সরবরাহ করতেন তা আসলেই এক বিস্ময়। জন্মেছিলেন প্রগতিশীল পরিবারে। প্রগতিকে ধারণ করতেন মনে প্রাণে।

১৯৬৮ সালেই বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের ভিপি নির্বাচিত হয়ে নারীদের এগিয়ে চলার পথে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্মম, জঘন্য হত্যাকান্ডের একজন ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী। এ হত্যাকান্ডে পরিবারের আরো অনেকের সাথে চার বছরের পুত্র অতি আদরের বাবুকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়ে সারাজীবনই বিপর্যস্ত এবং শোকাহত ছিলেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি নিজেও। শিশু পুত্রের নিষ্পাপ ছোট শরীরে হায়েনাদের বুলেট মা হিসেবে তার জন্য কী তীব্র কষ্টের তা তিনি ছাড়া কেউই অনুধাবন করতে পারবে না।

সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে নাট্য সংগঠন শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার, শতাব্দী শিশু থিয়েটার, আনন্দ লেখক সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্যাদির সাথে যুক্ত থেকে প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণ ও বিকাশে রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা। উইমেন্স ফেডারেশন কলেজ ও রেডক্রসে যুক্ত থেকে মানুষের সেবা করে গেছেন নিরলসভাবে। এত সংগ্রাম, কিংবা বিপর্যয়েও কখনো মানুষকে ছাড়েননি। বরং ছোট্ট সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের হারানোর তীব্র শোক ও অসহ্য বেদনা তার ভেতরে এক অসীম শক্তির সৃষ্টি করেছিল। নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা, অতুলনীয় দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, সাহস ও পোড়খাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা এই সব কিছুকে পাথেয় করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল আন্দোলন, সংগ্রামে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়েতের শাসনামলে বরিশাল অঞ্চলের মানুষকে এক বিভীষিকাময় অন্ধকার সময় পার করতে হয়েছে। বিশেষত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ছিল ভয়াবহ যা সে সময়ের বিশ্ব বিবেককেও নাড়া দেয়। সেই তমসাচ্ছন্ন সময়েও স্বভাবসুলভ ভাবে তিনি মানুষের পাশে থেকেছেন তাদের আশা হয়ে।

সাধারণের একজন হয়ে আজীবন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অবিরাম চেষ্টাই তাকে পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও স্বতন্ত্র সত্তা দিয়েছে। দুঃসময়ে দলীয় নেতাকর্মীদেরও পরম আশ্রয় ছিলেন। একই সাগরের ঢেউ হয়ে আমরণ তাদের সকলের সাথে মিশে থাকতেন গভীর যত্ন, স্নেহ আর মমতার নিরাপদ নোঙর হয়ে।

মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাস, ভালবাসা ও সমীহ সবই পেয়েছিলেন। ওপারে নিশ্চয়ই তিনি তাঁর সারাজীবনের পরম আরাধ্য আর আক্ষেপ শিশু সন্তান বাবুকে খুজে পেয়েছেন। জানতে চাইছেন মাকে ছাড়া এত বছর কেমন ছিল অসম্ভব মা ভক্ত বাবু? সেই কালরাত্রে তাঁর নিষ্পাপ ছোট্ট বাবু কতটা কষ্ট পেয়েছিল? সব কিছু উজাড় করে কিভাবে দেশকে ভালবাসতে হয়, মানুষের পাশে থাকতে হয়, জীবন সংগ্রামের কঠিন মুহূর্তে বুক চিতিয়ে লড়তে হয় রক্তে আগুন ধরা সেই সংগ্রাম ও সাহসের এক জীবন্ত পাঠ্য শহীদ জননী শাহানারা আবদুল্লাহ।

বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এসব রাজনেতিক পরিচয় ছাপিয়ে তার মূল পরিচয় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন রূপকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আর অসংখ্য মানুষের সঞ্জীবনী শক্তি। মরণের সঙ্গে লড়াই করে জীবনকে ছিনিয়ে এনেছেন আবার সেই জীবনকেই মানুষের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন হাসিমুখে।

এদেশের ইতিহাসে যে সকল নারী তাঁদের ত্যাগ, সংগ্রাম, দৃঢ়তা আর সাহসে বাঙালি জাতির আগুয়ান সদস্য হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শহীদ জননী শাহানারা আবদুল্লাহ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। যাঁর প্রতিরোধী মেরুদন্ড ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অফুরান উদ্যম, আত্মবিশ্বাস আর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

লেখকঃ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। Palash.lilak@gmail.com

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.