‘যে অমানিশার অন্ধকার আমাদের চারপাশকে ঘিরে ধরেছে, তা একদিন কেটে যাবেই। এই বাজেটের হাত ধরেই আমরা অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে আগের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক ভিত রচনা করব’- এমন মন্তব্য করে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশের স্বপ্ন দেখিয়ে আগামী অর্থবছরের রেকর্ড ঘাটতির বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অপরিহার্য ব্যয়ে কল্পনাবিলাসী আয় দেখিয়ে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামের আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যয় মেটাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
এর মধ্যে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এই আয় ও ব্যয়ের ফারাক ঘাটতি থাকবে (অনুদানসহ) ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
আর অনুদান ছাড়া এ ঘাটতির পরিমাণ হবে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, এটি জিডিপির ৬ শতাংশ। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারই প্রথম ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে।
বিদ্যমান মন্দা পরিস্থিতি উল্লেখ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির হিসাবনিকাশ সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৩ শতাংশ কমবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে-এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাবে বৈশ্বিক পণ্যবাণিজ্য কমবে ১৩-২০ শতাংশ। এ সময় কর্মহীন হয়ে পড়বে ১৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষ-এমন পূর্বাভাস আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও)। এ ছাড়া আঙ্কটাডের হিসাবে বিনিয়োগ কমবে ৫-১৫ শতাংশ।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের আঘাতে এ মুহূর্তে দেশের সার্বিক অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এরই মধ্যে কর্মহীন ও হতদরিদ্র হয়ে পড়েছে কয়েক কোটি মানুষ। বিপর্যয় নেমে এসেছে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে। বন্ধ আছে সব ধরনের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপির সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আদায়ের প্রক্ষেপণ বাস্তবসম্মত হয়নি। ঘাটতি পূরণে সরকারের ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নেয়ার চিন্তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনিতেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কম। এ অবস্থায় সরকার বড় অংকের ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরো কমবে। তাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রফতানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাস্তবসম্মত নয়। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। এনবিআর বলছে, তারা কর আহরণ করতে পারবে না। এটার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কারণ ব্যক্তি ও করপোরেট করহার অনেক ক্ষেত্রেই কমছে। বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড়ও দেয়া হচ্ছে। ফলে রাজস্ব আদায়ের হার নিম্নমুখী থাকবে। কিন্তু সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এতে ঘাটতি আরো বাড়বে। আবার ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতাও সমর্থনযোগ্য নয়। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে এতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমতে পারে। এছাড়া মূল্যস্ফীতিকেও তা বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে সামষ্টিক কাঠামোয় এটি অতিরঞ্জিত এবং মোটেও বাস্তবসম্মত বাজেট নয়।
কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বাজেটে যা বলা হয়েছে
করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হবার পর দেশের অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব সে নিয়ে এর আগে সরকারি কোন হিসাব জানা যায়নি।
কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল স্বীকার করেছেন, মহামারির কারণে বছরের শেষ কোয়ার্টারে এসে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের গতিও ভালোই ছিল।
“কিন্তু কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ সময় ধরে চলা লকডাউনের কারণে রপ্তানি কমায় এবং প্রবাসী আয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে ৫.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।”
এর বাইরে করোনার প্রভাবে দেশে ১৪ লাখের মতো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল।
এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি’র সাময়িক হিসাবের তথ্য তুলে ধরে তিনি এ কথা বলেন।
মহামারির কারণে গত কয়েক মাসে এ সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ হারিয়েছে বহু মানুষ, উৎপাদন কমেছে কৃষি ও শিল্প খাতে, সেবা খাতে বহু প্রতিষ্ঠান আয় হারিয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, এসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মহামারি মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা ”থোক বরাদ্দ” প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া মহামারির প্রভাব মোকাবেলায় সরকার যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো, বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে আয় বাড়ানো এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া, বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন মহামারির ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে।
এর মধ্যে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার লক্ষ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ তহবিল, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার এবং এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার দুটি আলাদা স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা রয়েছে।
কৃষি খাতে সরকার প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
অন্যদিকে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কিন্তু এসব পরিকল্পনাকে প্রয়োজনের তুলনায় ‘অপ্রতুল’ মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক।
“সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেটা ভালো। তবে, সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের একটি বড় অংশ পেনশন এবং স্কুলের বৃত্তিতে যায়। তারপরেও জিডিপির তিন শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু করোনার কারণে যে বিশাল-সংখ্যক জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে, তাদের জন্য কী ব্যবস্থা, বিশেষ করে নগর অঞ্চলের দরিদ্রদের জন্য? এই জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় আনা যায়, কীভাবে তাদের খাদ্য ও নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে তা নিয়ে কোন স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি আমরা দেখিনি।”
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ‘উচ্চাভিলাষী’
বাংলাদেশে আজ এমন এক সময়ে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন, যখন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাত বেশ বিপর্যস্ত।
আর ঘুরেফিরে বারবারই সে বিষয়টির প্রতিফলন দেখা গেছে বাজেট বক্তৃতায়।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার এই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় সে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের ২৬ তারিখ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, বন্ধ হয়ে যায় পরিবহন খাতসহ সব ধরণের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যা চলে ৬৬দিন পর্যন্ত।
এ সময়ে বহু মানুষ কর্মহীন হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে।
যে কারণে চলতি অর্থবছরের শেষে এসে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হয় সরকারকে।
কিন্তু এমন প্রেক্ষাপটেও চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বড় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য।
প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে, ৮.২ শতাংশ।
নতুন এই লক্ষ্যমাত্রাকে ‘উচ্চাভিলাষী’ ও ‘বাস্তবসম্মত’ নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি।
“এখন প্রেক্ষাপটটাই আলাদা। তাছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ইতিমধ্যে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থা অনেক কম হবে এমন প্রেডিকশন দিয়েছে। কিন্তু সরকারের প্রাক্কলন তার চেয়ে বেশি। এটা অনেক উচ্চাভিলাষী। এখন এটা কতটা অর্জনযোগ্য সেটা দেখার বিষয়।”