গাজায় প্রতিদিনই বাড়ছে নিহতের সংখ্যা, ছোট্ট ভূখণ্ডটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা গাজা যুদ্ধ নিয়ে তাদের বাড়তে থাকা সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
৭ অক্টোবর গাজা থেকে ফিলিস্তিনেদের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১,১৬০ জনকে হত্যা করে, জিম্মি করে নিয়ে যায় আরও ২৫০ জনকে।
সেদিন থেকেই তীব্র পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজায় ৩২ হাজারের বেশি মানুষ এরইমধ্যে নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখন, ইসরায়েল সরকার মিশর সীমান্তবর্তী দক্ষিণের শহর রাফাহ তে স্থল অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েল সরকার যেভাবে গোঁ ধরে আছে, বিশেষ করে রাফাহ তে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থল অভিযান চালানোর বিষয়টি নিয়ে দেশটির এগুঁয়েমিতে মিত্ররা উদ্বিগ্ন। ইসরায়েলের অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে ১১ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি রাফাহ তে আশ্রয় নিয়ে আছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলছেন, ফিলিস্তিনি জঙ্গি গ্রুপ হামাসকে নির্মূল করতে এই অভিযান জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশ হামাসকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
গাজা ভয়াবহ যে মানবিক বিপর্যয়ে পতিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে এবং একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান আরও জরুরি হয়ে উঠছে।
বাইডেন, নেতানিয়াহু মতবিরোধ
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে তোলা বেশ কয়েকটি রেজ্যুলেশন ‘ভেটো’ দিয়ে আটকে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিত্র বলা হয়। তবে তাদের সেই সম্পর্কে ফাটল স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এ সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং নেতানিয়াহু একটি ফোনালাপে বার বার তর্কে জড়িয়েছেন। বাইডেন বলেছেন, (রাফাহ) স্থল অভিযানের পরিকল্পনা ‘ভুল’। যেখানে নেতানিয়াহু নিজের অবস্থানে অটল রয়েছেন।
নেতানিয়াহু স্পষ্ট করেই বলেছেন, তার ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য আরও কয়েক সপ্তাহ প্রয়োজন। তবে তিনি নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র সরবেন না।
এদিকে গাজা ভূখণ্ডে আরও বেশি মানবিক বিপর্যয় নেমে আসার পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান নিয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হচ্ছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র একটি খসড়া রেজ্যুলেশনে গাজায় ‘একটি দ্রুত এবং টেকসই যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়েছিল। চীন ও রাশিয়া ‘ভেটো’ দিয়ে যা আটকে দেয়।
ওই উদ্যোগে একটি যুদ্ধবিরতির সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিনিময়ে হামাসের হাতে থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিষয়েও একটি ঐকান্তিক আলোচনার কথা বলা ছিল।
গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এখন মধ্যপ্রাচ্য সফরে রয়েছেন। এ সপ্তাহে তিনি বলেছেন, ‘একটি চুক্তি খুবই সম্ভব।’
অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেছে কানাডা
সম্প্রতি কানাডার পার্লামেন্টে ২০৪-১১৭ ভোটে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংবাদ সংস্থা এএফপি কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘গত ৮ জানুয়ারির পর থেকে কানাডা সরকার ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির আর কোনো অনুমতিপত্রে অনুমোদন দেয়নি। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের রপ্তানি নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্মত হতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের মত কানাডাও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের একজন। আর ইসরায়েলের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কারণে বাইডেনের মত কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকেও সমালোচিত হতে হচ্ছে।
কানাডা ছাড়াও জাপান, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনসহ আরো কয়েকটি দেশ ইসরায়েল অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করতে চলেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে স্পেন গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব অবস্থান নিয়েছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ইউরোপিয়ান কমিশনকে ইইউ-ইসরায়েল সমন্বয় চুক্তি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে বলেছেন। ইইউ ও ইসরায়েলের মধ্যে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে ওই চুক্তি হয়েছে।
সানচেজ এবং আয়ারল্যান্ডের সরকার প্রধান লিও ভারাদকার বলেছেন, ইসরায়েল মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা এবং মৌলিক গণতন্ত্রের মানদণ্ড লঙ্ঘন করতে পারে। যা ওই চুক্তির ভিত্তি।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক অবশ্য তাদের এই আহ্বান বাতিল করে দিয়েছেন। ব্রাসেলসে গত শুক্রবার শেষ হওয়া ইইউ সম্মেলনে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি
তবে আগের দিন বৃহস্পতিবার ইইউভুক্ত ২৭ দেশের নেতারা একটি যৌথ বিবৃতিতে গাজায় ‘অবিলম্বে একটি মানবিক বিরতির’ আহ্বান জানিয়েছেন। যা একটি ‘টেকসই যুদ্ধবিরতি, সব জিম্মির নিঃর্শত মুক্তি এবং মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করার পথে পরিচালিত হবে’।
গাজায় পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে এই প্রথম ইইউ থেকে সম্মিলিত কোনো বিবৃতি দেওয়া হলো। সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের প্রতি রাফাহতে স্থল অভিযান শুরু না করার আহ্বানও জানিয়েছে।