আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হবে বেসরকারি খাতের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। বাজেট প্রণয়নে বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা গুরুত্ব পাবে। রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত এক প্রাক–বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এ কথা বলেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এ আলোচনায় সহযোগিতা করে দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদের সঞ্চালনায় আগামী বাজেট সামনে রেখে চারটি বিষয়ের ওপর আলোচনা হয়। এগুলো হলো– আয়কর ও মূসক, আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং অবকাঠামো উন্নয়ন।
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন, সহজ ও দ্রুততম সময়ে সেবা প্রদান, কার্যকরী অবকাঠামোগত ও মানবসম্পদ উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য রাজস্ব বৃদ্ধি, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছতাসাধন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আমদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে আগামী বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এসব উদ্যোগ বেসরকারি খাতের প্রসারসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সার্বিকভাবে আগামী বাজেট হবে বেসরকারি খাতের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ এমপি বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করেন। বিদেশিরা ঝুঁকি নিতে চান না। তাই করের ক্ষেত্রে নীতির ধারাবাহিকতা দরকার। বিনিয়োগ বাড়াতে বন্ড ও বীমা খাতের উন্নয়ন দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, কর ব্যবস্থার আরও সহজীকরণ দরকার। অটোমেশন দিনকে দিন হচ্ছে। আরও দরকার। ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি যাতে তৈরি হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ এমপি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। আমাদের এখানে এক লাখ ২৫ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও এমন কিছু বিষয় পড়ানো হচ্ছে কর্মসংস্থানে যা ভূমিকা রাখতে পারছে না। কর্মসংস্থান, রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে এখন ১৪ শতাংশ গুণতে হচ্ছে। বাড়তি এই সুদের কারণে অনেকে খেলাপি হয়ে পড়বে। আবার ডলারের সরকারি দর ১১০ টাকা বলা হলেও আমদানিতে কিনতে হচ্ছে ১২৪ টাকায়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১২৪ টাকা ধরে শুল্কায়ন করছে। সরকারি অন্যান্য সংস্থা হিসাব করার সময় ডলারের দর ১১০ টাকা ধরে বলছে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দর বাড়ায়। এই অবস্থার অবসান দরকার। এছাড়া যারা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাইরে নিয়ে গেছে তাদের ধরতে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনতা দিতে হবে। কোনো অনিয়ম ধরার পর ব্যবস্থা নিতে দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে এখন এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদ মইসনুল ইসলামের মতে ব্যাংক খাতে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। বিভিন্ন ড্রেসিংয়ের মাধ্যমে অনেক খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর প্রবণতা রয়েছে।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, করের আওতা বাড়ানোর বিষয়টি যত সহজে বলা হয়, বিষয়টি তত সহজ নয়। তবে কর আহরণ এনবিআরের একমাত্র লক্ষ্য নয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন খাতে করহার কমানো হয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা ২০২০ সালের ২১ লাখ থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৭ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। বিআইনধারী ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০২০ সালের ২ লাখ থেকে এখন ৫ লাখে উন্নীত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে কীভাবে দেশের মধ্যে উৎপাদন বাড়ানো যায় সে ধরনের কর নীতি নেওয়া হয়েছে। উচ্চ মূল্য সংযোজিত রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সরকারের নীতির এরই মধ্যে মোবাইল, টেলিভিশন, ফ্রিজ এবং এসির উৎপাদন বেড়েছে। এসব পণ্যের ৯৫ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। লিফট, ফোর হুইলারের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর নীতি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন করা হয়েছে। এছাড়া এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাংক একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রোডম্যাপ অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অচিরেই ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও ভালো হবে। এছাড়া বন্ড মার্কেটকে শুক্তিশালী করার পাশাপাশি পুঁজিবাজারের উন্নয়নেও বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশ অনেক আগ থেকেই আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়ানোর নীতি নিয়েছে। তবে আমরা এক্ষেত্রে ব্যবসা–বাণিজ্যের কথা চিন্তা করে অনেক দেরিতে সুদহার বাড়িয়েছি। ‘স্মার্ট রেট’ নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেন। কেউ–কেউ বলেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে এটা করা হয়েছে। সেটা ঠিক নয়। স্মার্ট কার্যকর না করে কেবল বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সুদহার একবারে অনেক বেড়ে যেতো।
আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মহাবুবুর রহমানসহ ব্যবসায়ী নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আফতাবুল ইসলাম, রিজওয়ান রহমান, ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার. শামস মাহমুদ, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক কমিশনার আরিফ খান, এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন, ইউনিলিভার বাংলাদেশের কর বিভাগের প্রধান সাঈদ আহমেদ খান, সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারি, ইফাদ গ্রুপের পরিচালক তাসকিন আহমেদ, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের এমডি সৈয়দ আলী জওহর রিজভী প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য নীতির ধারাবাহিকতা দরকার। এছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের এখানে এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের সঙ্কট রয়েছে। তারা বলেন, ৯ শতাংশ সুদ হিসাব করে ঋণ নিয়ে এখন গুণতে হচ্ছে ১৪ শতাংশ। এতে করে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। বিনিয়োগে আগ্রহ হারবেন। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আবার ইচ্ছাকৃত খেলাপি এবং অনিচ্ছাকৃত খেলাপি সবার জন্য একই আইন থাকায় বৈষম্য হচ্ছে। এছাড়া ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ায় রপ্তানি বিল না এলে তিনি আর সুবিধা পাচ্ছেন না। এসব সমস্যা দূর করতে না পারলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা উৎসাহী হবেন না।