জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। আর ২০২০-২১ অথর্বছরের জন্য এনবিআরের যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, অর্জন করা সম্ভব হবে না তা-ও।
রাজস্ব আয়ের বাস্তব ও প্রকৃত চিত্রটিই যেন জানিয়ে দিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে চিঠি দিয়ে তিনি জানান, এনবিআরের চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। আর ২০২০-২১ অথর্বছরের জন্য এনবিআরের যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, অর্জন করা সম্ভব হবে না তা-ও।
চলতি অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। কোভিডজনিত দুর্যোগ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা একপ্রকার অসম্ভব হবে। এদিকে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছরই রাজস্ব আয় বাড়ছে। কিন্তু এবারই আগের অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয় কমতে যাচ্ছে। কমার পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর চেয়ারম্যান ১৪ মে অর্থসচিবকে চিঠি দিয়ে এসব কথাও জানান।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করা হয়েছিল, এ কথা উল্লেখ করে চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে তা হতে পারে বড়জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে এনিবআরের আদায় কমবে ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে আদায় কমবে ৮০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপিত হওয়ার কথা আগামী ১১ জুন। আগামী অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ধরা হচ্ছে বলে এনবিআরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রহমাতুল মুনিম এ নিয়ে চিঠিতে বলেন, এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে তিনি আশাবাদী নন। কারণ, ১ জুলাই থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া রেখে যাবে।
যোগাযোগ করা হলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম চিঠি নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।
লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব
এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে জানান, বর্তমান অর্থবছরের সম্ভাব্য আদায়ের ওপর আগের গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ধরে হিসাব করলেও আগামী অর্থবছরের মোট আহরণ ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। এনবিআর রাজস্ব সংগ্রহ করে মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও শুল্ক—এ তিন খাত থেকে। এর মধ্যে মূসক থেকে ৯৭ হাজার ৫৯ কোটি, আয়কর থেকে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৭৩ হাজার ১৯২ কোটি টাকা আসতে পারে।
চেয়ারম্যানের মতে, চলতি অর্থবছরের ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূসক থেকে ৮৫ হাজার ৪১২ কোটি, আয়কর থেকে ৭০ হাজার ১৮০ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৬৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা আসতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব সংগ্রহের গতিপ্রকৃতি এবার শুরু থেকেই ইতিবাচক ছিল না। কোভিড-১৯ আসার পর তা বেশি খারাপ হয়েছে। নিঃসন্দেহে এনবিআরের জন্য বড় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। এক লাফে অর্থাৎ এক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবোচিত নয়। মুশকিল হচ্ছে, মৌলিক জায়গায় হাত দেওয়া হচ্ছে না।
মৌলিক জায়গাটি কী, ব্যাখ্যা চাইলে মির্জ্জা আজিজ বলেন, করের আওতা বাড়াতে হবে। তা না করে প্রতিবছর যারা কর দেয়, তাদের ওপর আরও চাপ দেওয়া হয়।
রাজস্ব কর্মকর্তাদের মানসিক চাপ
এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে আরও লিখেছেন, অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের ওপর একধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। অসম্ভব বিবেচনা করে অনেকে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর হয়রানির অভিযোগও আসে। আর লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক হলে রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে তা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কৃতিত্ব পাওয়ার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। এনবিআরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণের জন্য অর্থসচিবকে অনুরোধ জানান তিনি।
অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজেট প্রতি অর্থবছরেই বড় করা হয় বলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রাও বড় রাখা হয়। আর এ পর্যায়ে এসে লক্ষ্যমাত্রা কমানোর কোনো সুযোগ নেই।
আদায় কমে চেয়ারম্যানের যুক্তি
আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম চিঠিতে জানান, চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে নতুন মূসক আইন চালু ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধির আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস-জনিত মহামারি সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কারও পক্ষেই তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ কর আহরণব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের সব মানুষের ভোগ-চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় ভোগের চাহিদা কমলে আমদানি কমবে, শিল্প উৎপাদন কমলে কাঁচামাল যন্ত্রপাতির চাহিদা কমবে। এতে পরোক্ষ করের ওপর ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে আয়বর্ধক কার্যক্রম কমলে এবং অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে কমবে প্রত্যক্ষ করও।
এ ছাড়া নিকট আগামী সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বড় একটি অংশ জনগণের মৌলিক চাহিদা-সেবায় নিয়োজিত হবে। যার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসন ও জনগণের নিরাপত্তা। এসব মৌলিক উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ ও সেবার বেশির ভাগই সম্পূর্ণ করমুক্ত বা ন্যূনতম করের আওতাধীন।
এনবিআরের ওপর ভালোই চাপ থাকে, এমন মন্তব্য করে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুইয়া বলেন, এনবিআরের উচিত হবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট থাকা। তবে বাজেট যেহেতু উচ্চাভিলাষী, তাই অর্জন করতে না পারলে এনবিআর কর্মকর্তাদের দোষারোপ করা ঠিক হবে না।