The news is by your side.

খাবারের আশায় ত্রাণ চাইতে আসা ১১২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

0 101

 

গাজা উপত্যকায় স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর ত্রাণ সরবরাহকারী লরির দিকে একটু খাবারের আশায় ছুটে যাওয়া মানুষের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে অন্তত ১১২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শহরের বাইরেই উপকূলের রাস্তা ধরে রাতের অন্ধকার চিরে যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ত্রাণবাহী গাড়ির বহর আসছিল, তখন সেটা ঘিরে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। মৃতের সঙ্গে আরো ৭৬০ জন আহত হয়েছে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় নানা প্রশ্ন উঠছে—ঠিক কী ঘটেছিল এবং এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আসলে দায়ী কে? এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি যেসব দাবি করা হচ্ছে বিবিসি ভেরিফাই সেগুলোর প্রধান তথ্য—এগুলো কখন এবং কোন জায়গা থেকে বলা হয়েছে সেসবের ওপর নজর দিয়েছে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোযাগোম মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা ভিডিও, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) ড্রোন ফুটেজগুলো একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে কী ঘটেছিল এ ব্যাপারে আমরা কী জানি আর কী জানি না তা খোঁজা হয়েছে।

সাহায্যের আশায় শত মানুষের অপেক্ষা

২৮ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েক শ মানুষ আগুন জ্বালিয়ে একসঙ্গে বসে অপেক্ষা করছে মানবিক ত্রাণ সরবরাহ এসে পৌঁছনোর আশায়।

উত্তর গাজা, যেখানে প্রায় তিন লাখ মানুষ সামান্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ওপর টিকে আছে, সেখানে একটা দুর্ভিক্ষ আসন্ন—এমন সতকর্তা দিয়ে আসছিল জাতিসংঘ। কারণ কয়েক সপ্তাহ ধরে এই অঞ্চলে খুবই কম সহায়তা এসে পৌঁছচ্ছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, গাজার দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে উপকূলের রাস্তা আল-রাশিদ স্ট্রিটে মানুষ এসে আসন গেড়েছে। এই এলাকা সাম্প্রতিক সময়ে ত্রাণ বিতরণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল।

এর আগে এই এলাকার অন্য ভিডিও, যেখানে মানুষ লরি ঘিরে সাহায্যের বস্তা পাওয়ার আশায় ভিড় করেছে, সেটার সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিক মাহমুদ আওয়াদিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘অসংখ্য মানুষ সেখানে হন্যে হয়ে খাবার ও আটার ব্যাগ খুঁজছিল।’

ত্রাণের বহর আস্তে আস্তে জনতার ভিড়ের দিকে আসে

স্থানীয় সময় ২৯ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টার দিকে মিসর থেকে আসা ত্রাণ বহনকারী লরির বহর আইডিএফের এলাকা দিয়ে উত্তরে আল রাশিদ স্ট্রিটের দিকে আসতে থাকে। আইডিএফ বলছে, এই বহরে ৩০টি লরি ছিল, কিন্তু বিবিসিকে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেখানে আসলে ১৮টি বা তার কম লরি ছিল।

আইডিএফের প্রধান মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, পৌনে ৫টার দিকে যখন বহরটি গাজা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে নাবুলসি মোড়ে এসে পৌঁছয়, তখন সেটি ঘিরে ধরে জনতার ভিড় ছিল।

মানুষ ট্রাক ঘিরে ধরে

আইডিএফের প্রকাশ করা ইনফ্রারেড ড্রোন ফুটেজের একটা স্ক্রিনশট এটি। আইডিএফ যে ভিডিওটি প্রকাশ করেছে সেটা একটা নির্দিষ্ট কোনো দৃশ্যের নয়। চারটি আলাদা ভাগে এটি এডিট করা হয়। ভিডিওতে দুটি ভিন্ন জায়গার ঘটনা দেখানো হয়, যে দুটি জায়গায় চিহ্নিত করতে পেরেছে বিবিসি ভেরিফাই।

ভিডিওর প্রথম দুই অংশে যেখানে মানুষকে দুই বা ততোধিক লরি ঘিরে ধরতে দেখা যাচ্ছে সেটা নাবুলসি মোড়ে একেবারে দক্ষিণে।

বহরের শেষ দিকের দৃশ্য

ভিডিওর পরের দুটি অংশে আরেকটু দক্ষিণে ৫০০ মিটার জায়গার ঘটনা দেখানো হয়। যেখানে দেখা যায়, কমপক্ষে চারটি লরি দাঁড়িয়ে আছে এবং যথারীতি মানুষকে সেটার আশপাশে ভিড় করে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এই সময়টায় সম্ভবত প্রাণহীন দেহ মাটিতে পড়ে থাকতেও দেখা যায়। আইডিএফের প্রকাশ করা ভিডিওর স্ক্রিনশট থেকে পাওয়া ছবিতে এটি লাল বক্স দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে এখানে দেখা যায়, পাশেই ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গাড়ির উপস্থিতি। বিবিসি ভেরিফাই আইডিএফের কাছে এই পুরো ঘটনার ভিডিও চেয়েছে।

গুলি

আলজাজিরার আরেকটি এক্সক্লুসিভ ভিডিও, যেটা বহরের পেছন দিকে মোড় থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণের অংশে, সেটাও যাচাই করা হয়েছে। এখানে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায় এবং মানুষকে লরির ওপরে বা নিচে আশ্রয় খুঁজতে দেখা যায়। এ সময় আকাশে লাল ট্রেসার ছুড়তেও দেখা যায়।

মাহমুদ আওয়াদিয়া জানান, সাহায্য পৌঁছনোমাত্র ইসরায়েলি গাড়িগুলো থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলিরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে…তারা যখন আটা বহনকারী ট্রাকের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তাদের দিকে সরাসরি তাক করে গুলি করা হয় এবং তাদের হত্যা করে ট্রাকের কাছে আসা আটকানো হয়।’

হতাহতের পরিমাণ

এই গোলাগুলির ঘটনাস্থলের আরো কিছু ভিডিও যাচাই করা হয়, যেখানে একটা গাড়িতে তুলে মৃতদেহগুলো উত্তরে নাবুলসি মোড়ের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানোর কথাও উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। এর মধ্যে অনেক মৃত ও আহতকে আনা হয় আল-আউদা হাসপাতালে, সেটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক ড. মোহামেদ সালহা বিবিসিকে বলেন, ‘আল-আউদা হাসপাতালে ১৭৬ জনের মতো আহত মানুষ আসে…যার মধ্যে ১৪২ জনের শরীরে গুলির আঘাত এবং বাকিরা হয় পদদলিত হয়েছে এবং শরীরের ওপরে ও নিচের দিকে বিভিন্ন অংশ মচকে বা ভেঙে গেছে।’

ইসরায়েলি ব্যাখ্যা

বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৬ মিনিটে টেলিগ্রামে আইডিএফ একটা বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, ‘আজ সকালে গাজা উপত্যকার উত্তরে যখন মানবিক সহায়তা নিয়ে ত্রাণবাহী ট্রাক আসছিল, সে সময় গাজার অধিবাসীরা ট্রাকটি ঘিরে ধরে এবং সহায়তাগুলো ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার সময়, ধাক্কাধাক্কি ও পদদলিত হয়ে গাজার কয়েক ডজন অধিবাসী আহত হয়েছে।’

দুপুর ৩টা ৩৫ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক্সে আরেকবার একই রকম বক্তব্য দিয়ে এই বিবৃতি প্রকাশ করে আইডিএফ।

যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইডিএফের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার লার্নার বলেন, ‘একদল উত্তেজিত জনতা এই বহরের দিকে এগিয়ে এসে এটাকে থামিয়ে দেয়। সে সময় বহরের নিরাপত্তায় যে ট্যাংকগুলো ছিল, তারা দেখে যে মানুষজন ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হচ্ছে, তখন তারা কয়েকটি সতর্ক বুলেট ছুড়ে এই ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করে।’

এরপর স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে এক্সে এক ভিডিও বার্তা আসে, যেখানে আইডিএফে ড্যানিয়েল হাগারি দাবি করেন, ‘কয়েক শ মানুষ থেকে তা কয়েক হাজার মানুষে রূপ নেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।’

তিনি বলেন, ট্যাংক কমান্ডার এ সময় পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন যাতে বেসমারিক নাগরিকদের কোনো ক্ষতি না হয় এবং ‘তারা নিরাপদে সতর্কভাবে সেখানে ছিল এবং জনতার দিকে কোনো গুলি ছোড়া হয়নি।’

তারও কিছুক্ষণ আগে গ্রিনিচ সময় ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা মার্ক রেজেভ বলেন, ইসরায়েল কোনোভাবেই সরাসরি কিছুতে যুক্ত হয়নি এবং সেখানে ছিলই না।

তিনি আরো দাবি করেন, আইডিএফ গুলি ছুড়েছে অন্য একটা ঘটনায়, যার সঙ্গে এই ত্রাণ বহরের কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও তিনি তাঁর দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করেননি।

রেজেভ বলেন, ‘ট্রাক লুটের সময় সেখানে গুলি ছোড়া হয়েছে, আর সেটা করেছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তবে আমরা জানি না সেটা হামাস ছিল, নাকি অন্য কোনো গ্রুপ।’

বিশ্বনেতারা এখানে ঠিক কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। উদ্বেগ আরো বেড়েছে, যখন মঙ্গলবার জাতিসংঘের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, গাজার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ভয়াবহ মাত্রার খাদ্যাভাবে পড়তে যাচ্ছে।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.