স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নিজের অবস্থান আবারও স্পষ্ট করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের বৈধ আকাঙ্খা সমাধানের একমাত্র উপায় দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান। এটি পারস্পরিক ভয়, ঘৃণা ও সহিংসতার অন্তহীন চক্র থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায়। ইসরায়েলের ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের সুস্পষ্ট ও ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান’ অগ্রহণযোগ্য। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মঙ্গলবার এ কথা বলেন তিনি। ইসরায়েলের আগ্রাসনের ক্ষতিগ্রস্ত গাজায় ত্রাণ পাঠানো নিয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্বীকৃতি চরমপন্থীদের উৎসাহিত করবে। এটি গাজায় সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত করবে। এক সপ্তাহ আগে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে অগ্রাহ্য করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্যের বিষয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, এটি বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলবে। চলমান সংঘাত অনির্দিষ্টকালের জন্য জিইয়ে থাকবে।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, গাজায় যুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করবেন তিনি। বিষয়টি তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, জর্ডান নদীর পশ্চিমের সমস্ত ভূমির ওপর ইসরায়েলের নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এখানে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়ে থাকে। এটি একটি প্রয়োজনীয় শর্ত এবং এটি (ফিলিস্তিনের) সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কি করতে হবে? আমি আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের এই সত্যটি জানিয়ে দিয়েছি। আমাদের ওপর এমন একটি বাস্তবতা (ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা) চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও আমি বন্ধ করে দিই যা ইসরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষতি করবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলের মিত্ররা চিরশত্রু এই দুই দেশের সংঘাত নিয়ন্ত্রণে ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেন যেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এর লক্ষ্য- ওই অঞ্চলে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা। তবে এই প্রথম ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রত্যাখ্যান করলেন প্রকাশ্যে। এ অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চিড় করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে নিজেদের ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইহুদিদের পুনর্বাসন করা হয়। তারও আগে থেকে ওই অঞ্চলের আরবদের উচ্ছেদ করে ব্রিটেন। এরপর থেকে অবৈধভাবে পর্যায়ক্রমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে বসানো হয় ইহুদি বসতি। এমনকি মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র আল-আকসা মসজিদও নিয়ন্ত্রণে নেয় জায়ানবাদীরা।
এসব নিয়ে লেগেই আছে সংঘাত। ফিলিস্তিনিরা কখনোই নিজেদের বসতভিটা হারানো এবং আল-আকসার প্রার্থনায় বাধা দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি, মেনে নেননি জাতিসংঘের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানও। তারপরও এতেই একমাত্র সমাধান দেখেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা। তারা সেই সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসানে দুই রাষ্ট্র সমাধানের ধারণা কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আলোচিত হয়ে আসছে। এই কূটনীতির মূল ভিত্তি ইসরায়েলের পাশাপাশি সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
ফিলিস্তিনিদের ভূমি উদ্ধারের আন্দোলন নিয়ে বহু সংঘাত-যুদ্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল দ্বিরাষ্ট্রের সমাধানের কথা বলেছে। কার্যত তারা সমাধান করেনি। এখন ইসরায়েল পুরো জেরুজালেম নগরীকেই তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। আল-আকসায় প্রার্থনায় বাধা ও ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ নিয়ে বিরোধ ও সংঘাতে প্রাণহানিও ঘটেছে প্রচুর। এমন পরিস্থিতিতে ফের দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাইডেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই সংঘাতের ‘একমাত্র জবাব’। তিনি দ্বিরাষ্ট্রের সমাধানের কথা বললেও বাস্তবে তার এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। এ জন্য বিশ্নেষকরা বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে এই সংকটের সমাধান দেখা যাচ্ছে না।