মূল্যস্ফীতি কমানোকে প্রধান অগ্রাধিকার দিয়ে আরও কঠোর মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বর্তমান পর্যায় থেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সুদের হার বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমাতে চায়। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে চার ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ-প্রধানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। গভর্নরের প্রারম্ভিক বক্তব্য শেষে মুদ্রানীতির ভঙ্গির ওপর উপস্থাপনা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এর পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন গভর্নর। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা, ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট, দীর্ঘদিন ধরে পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাব ও সিআরআর ঘাটতি, ডলারের অভাবে এলসি খুলতে না পারাসহ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন গভর্নর।
নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার হিসেবে বিবেচিত রেপোর সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। এ নিয়ে টানা ৭ দফায় রেপোর সুদহার ৩২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ল। আর রিভার্স রেপোর (বর্তমানে যা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে। এ ছাড়া স্পেশাল রেপোর (বর্তমানে যা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিল নেওয়ার খরচ বাড়িয়ে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আগের মুদ্রানীতিতে আগামী জুনে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ধরা হয়েছিল ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রকৃত বেড়েছে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন নাগাদ ১০ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন আগের ৩১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৭ দশমিক ৮০ শতাংশে নামানো হয়েছে। নিট বৈদেশিক সম্পদ এবং মুদ্রা সরবরাহের প্রাক্কলনও কমানো হয়েছে। তবে কোনোভাবে উৎপাদনশীল খাত যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কৃষি, এসএমই, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য কম সুদে পুনঃঅর্থায়ন দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে এ ধরনের আরও পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হবে।
মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমাতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ এবং প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতির সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করেছে সরকার। এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অগ্রাধিকার। এ লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও ১ শতাংশ কম হয়, তা নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামানো পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ধারা বজায় থাকবে।
ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরে নামনোর ঘোষণা দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ডিসেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমানোর নতুন ঘোষণা কতটুকু বাস্তবসম্মত– এমন প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য দুটি বিষয় রয়েছে। একটি অর্থনৈতিক, অপরটি অর্থনীতি-বহির্ভূত। অর্থনৈতিক বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোরভাবে দেখছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদহার বাড়ানো এবং মুদ্রা সরবরাহ কমানো হয়েছে। গত বছরের আগস্ট থেকে সরকারকে আর টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। উল্টো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেনা শোধ করছে। এখন অর্থনীতি-বহির্ভূত বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে নতুন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। রোববার সব পক্ষকে নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান বলেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে বেশ আগে থেকেই আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়িয়েছে। দেরিতে শুরু হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বাড়াচ্ছে। ট্রেজারি বিলের সুদহার যেভাবে বাড়ছে, আগামীতে গ্রাহক পর্যায়ে সুদ আরও বাড়বে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে অপরিবর্তিত ছিল। গত জুলাই থেকে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের (স্মার্ট) সঙ্গে তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। চলতি মাসে ঋণের সুদহার ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে উঠেছে।
কেন তারল্য সংকট: ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন উপায়ে প্রচুর ধার নিচ্ছে। ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের পেছনে আস্থা সংকট প্রধান কারণ কিনা–এমন প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, কোনো আস্থার সংকট নেই। গত ৫২ বছরে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। আগামীতেও বন্ধ হবে না। তবে ব্যাংক একীভূতকরণের একটি নীতিমালা করা হয়েছে। কিছু ব্যাংক একীভূত করলে হয়তো এ খাত আরও শক্তিশালী হবে। এ ছাড়া আগামীতে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বেশি জোর দেওয়া হবে।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, শুধু ইসলামী ব্যাংকগুলো নয়; প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার করছে। এসব ব্যাংকের হাতে প্রচুর সিকিউরিটিজ থাকায় তাদের ধার নিতে সমস্যা হচ্ছে না। তা না হলে পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের মতো আরও অনেক ব্যাংকের চলতি হিসাব নেতিবাচক হতো। ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ সমস্যা পদ্ধতিগত।
পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাব নেতিবাচক থাকার পরও কীভাবে লেনদেন করছে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি ব্যাংক যখন আর কোনোভাবেই ধার নিতে পারে না; ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট’ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনসম্মত উপায়ে গভর্নর এসব ব্যাংকে টাকা দিতে পারেন। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কারও ভয়ে তিনি ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না– তেমন নয়। তিনি যদি ভয়ই পেতেন, তাহলে তো সরকারের নিয়মিত চাকরি ছেড়ে গভর্নরের চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে আসতেন না। কিছু ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন জোরদারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ধারা আগামীতেও বজায় থাকবে।
।