পণ্য রপ্তানিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি বাজারনির্ভরতা দীর্ঘদিনের। বিশ্বের ২০৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশ আসে মাত্র চারটি বাজার থেকে। বাকি ২০২টি বাজার থেকে আসে মাত্র ৩০ শতাংশ। এ চার বাজারনির্ভরতাকে রপ্তানি খাতের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বাস্তবতায় নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা চলছে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নতুন বাজার গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ। মধ্যপ্রাচ্যের ১৮ দেশের উপযোগী পণ্য সরবরাহে স্থানীয় চাহিদা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোন মৌসুমে কী ধরনের রঙের প্রাধান্য তারও গবেষণা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টিতে কূটনীতিকদের কাজে লাগানো হচ্ছে। চাহিদা বোঝা এবং সরকার ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন বিজিএমইএ নেতারা। প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি নতুন বাজার সৃষ্টিতে মনোযোগ দিচ্ছেন তারা। জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সমকালকে বলেন, প্রচলিত বাজারের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে চান তারা।
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোকে লক্ষ্য করে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব বাজারে কী ধরনের পোশাকের চাহিদা বেশি, কোন মৌসুমে কী ধরনের পোশাকের কদর রয়েছে– এসব বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। গত মাসে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ সফর করেছেন তারা। সফরে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীর সঙ্গে সফল আলোচনা হয়েছে। তারা অনেকে এর মধ্যে বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে আলোচনা করছেন। রপ্তানি আদেশও দিয়েছেন কেউ কেউ। মধ্যপ্রাচ্য করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে পর্যটন আকর্ষণে সৌদি আরবসহ অন্য দেশগুলো নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে স্থানীয়দের চাহিদার পাশাপাশি পর্যটকদের মাধ্যমেও রপ্তানি বাড়ানোর বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাজার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু উদ্যোগ আছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান সমকালকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাজার সম্প্রসারণে সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের একক মেলা এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। আবার স্থানীয় মেলা এবং প্রদর্শনীতেও দেশের উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শনীর সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি বাড়াতে আরও কী করা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন তারা। পোশাক রপ্তানিতে মধ্যপ্রাচ্যের ১৮ দেশের মধ্যে বড় বাজার হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমিরাতে রপ্তানি হয়েছে ২৯ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পোশাক, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৮ কোটি ২৪ লাখ ডলার। রপ্তানি বেড়েছে ৫ শতাংশের মতো। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও রপ্তানিতে গতি অব্যাহত আছে। আগের একই সময়ের চেয়ে এই দুই মাসে রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশের মতো। অন্যদিকে সৌদি আরবে গত অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি ডলারের পোশাক। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৪ কোটি ডলারের কিছু বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২২ শতাংশের মতো। রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ডলারের পোশাক।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের পোশাকের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের জোব্বা, শেরওয়ানি, আম্মামা, পাগড়ি, সিরওয়াল ইত্যাদি। এ ছাড়া শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ব্লেজারের চাহিদাও রয়েছে সেখানে। সরাসরি আমদানি ছাড়াও বহুজাতিক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের মাধ্যমে অন্যান্য দেশ থেকেও মধ্যপ্রাচ্যে যায় মেইড ইন বাংলাদশের পোশাক।
বর্তমানে বাংলাদেশের চার প্রধান বাজার হচ্ছে– ২৭ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপান। গত অর্থবছর সার্বিক রপ্তানিতে ইইউর অংশ ছিল ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। রপ্তানি হয় ২ হাজার ৫২৪ কোটি ডলারের। একক বড় বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ৯৭০ কোটি ডলার। তৃতীয় বড় বাজার জাপানে রপ্তানি হয় ১৯০ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট রপ্তানির ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। চতুর্থ বড় বাজার কানাডায় রপ্তানি হয় ১৭২ কোটি ডলারের পণ্য। মোট রপ্তানি আয়ে যার অংশ ৩ দশমিক ১০ শতাংশ।