ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে চলতি বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এই ২২ দিন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা কঠোর নজর রাখবেন। এ সময় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মানতে হবে জেলে, আড়তদার, বিপণনকারী, গুদামজাতকারী ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের। আর আইন অমান্যকারীকে মৎস্য আইনে সাজা দেওয়া হবে।
জানা গেছে, গত ২০ সেপ্টেম্বর ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন-সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সময় দেশব্যাপী ইলিশ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময়ও নিষিদ্ধ থাকবে এবং একই সঙ্গে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাস্তবায়ন করা হবে। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকাকালে ইলিশ আহরণে বিরত থাকা জেলেদের সরকার ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা দেবে বলেও ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন-সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে আইন অমান্যকারী কমপক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ইলিশ ধরা বন্ধকালে যাতে পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা অবৈধ মৎস্য আহরণ করতে না পারে, সে জন্য সাগরে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী ব্যবস্থা নেবে। নৌ পুলিশ এ বছর নদীতে ভাসমান ফাঁড়ি পরিচালনা করবে। এ সময় সার্বক্ষণিক একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু থাকবে। রাতে টহল জোরদার করবে। নৌবাহিনী ৯টি জাহাজের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করবে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ভারতীয় কোস্টগার্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করবে, যাতে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরতে না পারে।
উল্লেখ্য, প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর অধীন প্রণিত প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫ অনুযায়ী প্রতিবছর প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ সময় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা সরকারি তালিকাভুক্ত ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪৪টি জেলে পরিবারের জন্য খাদ্যসহায়তা বাবদ চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি জেলে পরিবার চাল পাবে ২০ কেজি করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের মানবিক খাদ্যসহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩৭ জেলার ১৫১টি উপজেলায় এ খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মা ইলিশ রক্ষায় এ সময় দেশের ৩৮টি জেলায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে প্রশাসন। ১১ অক্টোবর বুধবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান ২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে। এ সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় মৎস্য দফতর, বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী সমন্বিতভাবে এ অভিযান পরিচালনা করবে।
অভিযান বাস্তবায়নকালে ২০টি জেলা—বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ঢাকা, কক্সবাজার ও বাগেরহাট, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম জেলার সব নদ-নদী, মোহনা ও সাগরে ইলিশসহ সব রকমের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।
বাকি ১৮টি জেলা— জামালপুর, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, কুষ্টিয়া নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও নড়াইল জেলার নদ-নদীতে শুধু ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।
প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট-১৯৫০-এর অধীন প্রণিত ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস-১৯৮৫ অনুযায়ী এ বছর ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
অভিযান চলাকালে ৩৮ জেলার আকাশ, নদী ও সমুদ্রপথে বিশেষ টহল জোরদার করবে স্থানীয় প্রশাসন। এ সময় আইন না মানলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া গবে। ইলিশ ধরা বন্ধকালে যাতে পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা অবৈধ মৎস্য আহরণ করতে না পারে, সে জন্য সাগরে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী ব্যবস্থা নেবে। নৌ পুলিশ এ বছর নদীতে ভাসমান ফাঁড়ি পরিচালনা করবে।
এ সময় সার্বক্ষণিক একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু থাকবে। রাতে টহল জোরদার করবে। নৌবাহিনী তাদের জাহাজের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করবে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ভারতীয় কোস্টগার্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান চালাবে, যাতে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরতে না পারে।
এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বরফকল বন্ধ রাখা, বাজার তদারকি এবং স্থানীয় মৎস্যজীবী, রাজনৈতিক নেতারা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে সচেতনতা ও প্রচারণামূলক ব্যবস্থা নেবে। মা ইলিশ সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করলে কোনও রকম ছাড় দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব ড. নাহিদ রশীদ জানিয়েছেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে মৎস্য উৎপাদন বাড়ছে। ইলিশ মাছকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। মৎস্যবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ইলিশের সর্বোচ্চ প্রজনন সময় বিবেচনা করে এ বছর ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
মৎস্য ও প্রণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদই শুধু নয়, এটি জিআই সনদপ্রাপ্ত একটি সম্পদ, যা বিশ্বপরিমণ্ডলে আমাদের আলাদা পরিচয় বহন করে। ইলিশ সংরক্ষণে মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, মৎস্যজীবী ও মৎস্যজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের কারণে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। আর উৎপাদন বাড়লে মৎস্যজীবীরাই সে ইলিশ আহরণ করে লাভবান হবেন। সরকার শুধু ইলিশ উৎপাদনের পরিসর বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।