দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জানতেনই না, নিজের জন্মদিন কবে। কখনো কোনো প্রয়োজনে জন্মদিন জানার দরকার হলে বাবার ডায়েরিতে চোখ বুলিয়ে নিতেন, তারপর হয়তো আবার ভুলেও যেতেন।
একদিন বাবার ডায়েরিতে চোখ বোলাতে গিয়ে হঠাৎ চমকে ওঠেন ফেরদৌসী মজুমদার। সেবারই প্রথম খেয়াল করেন, একই দিনে জন্ম নিয়েছে তাঁর মেয়ে ত্রপা মজুমদার। সেদিন মেয়েকে জড়িয়ে আবেগে ভেসেছিলেন। মেয়ের বয়স তখন ছয় কি সাত বছর। সেদিন থেকেই দিনটি বিশেষ হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আজ ৮০ পূর্ণ করলেন ফেরদৌসী মজুমদার আর ত্রপা মজুমদার ৫০।
ফেরদৌসী মজুমদার বললেন, ‘সেদিন আমি চমকিত হয়েছিলাম। আনন্দিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এই প্রাপ্তি অনন্য। বারবার মনে হচ্ছিল, এত বছর পর কেন বাবার ডায়েরি দেখলাম। একটা মায়ের এই প্রাপ্তি কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। মা–মেয়ে দিনটি আমরা উপভোগ করি।’ তখন ঘরোয়াভাবে মা–মেয়ের জন্মদিন উদ্যাপিত হতো।
এসব দিন ব্যক্তিগত, তাঁরা চাইতেন, একান্ত ব্যক্তিগতভাবেই সেটা পালিত হোক। কিন্তু তা আর থাকল কই। জানাজানি হয়ে গেল মা–মেয়ের জন্মদিন। এখন তো ১৮ জুন ফুলে ফুলে ভরে যায় বাসা, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আনাগোনা করেন লোকজন। একসঙ্গে কেক কাটেন মা–মেয়ে। গীত হয় মা–মেয়ের পছন্দের গান। কখনো কখনো বাইরেও খেতে যাওয়া হয়।
জন্মদিনে কে কাকে আগে সারপ্রাইজ দিতে পারেন, এ নিয়ে রয়েছে মজার ঘটনা। তাঁদের বাসায় লম্বা একটা বারান্দা আছে। মাঝরাতে একবার তার এক পাশে অপেক্ষা করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। অন্য পাশে ত্রপা মজুমদার। কেউ কাউকে দেখতে পাননি। দুজনের উদ্দেশ্য, জন্মদিনের প্রথম প্রহরে অন্যকে চমকে দেওয়া। ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘অন্ধকারে আমি আসছি, সে–ও আসছে। পরে দুজনের গায়ে ধাক্কা। তখন ত্রপা বলল, আমি তোমার জন্য একটি জিনিস এনেছি। আমি বলি, তোর জন্য আমিও গিফট এনেছি। তখন আলো জ্বালিয়ে দুজন গিফট দিলাম।’
শৈশব থেকেই তাঁর জন্য মাকে ছাড় দিতে দেখেছেন ত্রপা। মায়ের প্রসঙ্গ উঠলে এই একটা বিষয়ে মেয়ের আজও ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের দেখা হয়েছিল। তিনি মাকে অভিনয়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি ছোট ছিলাম বলে মা তেমন কিছু বলেননি। আবার সূর্য দীঘল বাড়ীতে মায়ের অভিনয় করার কথা ছিল। সেবারও আমার কথা ভেবে মা করেননি। মায়ের এই ফিরিয়ে দেওয়া কাজগুলোর জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু মায়ের সেই এক কথা, কোনো আক্ষেপ নেই।’
পরিবারের এক সন্তান হওয়ার কারণে শিক্ষক, বন্ধু যা–ই বলা হোক না কেন, ত্রপার সবই ছিল মা। কখনো মায়ের জন্য তেমন কিছু করার খুব একটা সুযোগ হয়নি। তবে জন্মদিনটা আলাদা। এই দিনে অনেক আগে থেকেই মায়ের পছন্দের অনেক কিছু নিয়ে অপেক্ষা করেন। মা হয়তো কখনো বললেন, কিছু একটা প্রয়োজন। সেটা টুকে রাখতেন মেয়ে। কখনো সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেও বাকি সময়ে জন্মদিনে সেটা দিতেন। কখনো গয়না, শৌখিন জিনিস উপহার দিয়েও মাকে চমকে দিতেন। এবার মাকে কী দেবেন? এমন প্রশ্নে ত্রপা বলেন, ‘উপহার তো দেওয়াই হয়। এবার মা আমার কাছে চেয়েছেন লাল রঙের ছোট সুইচ। মায়ের শখ হয়েছে। কিন্তু এখনো আশপাশে এটা কোথায় পাইনি,’ বলেই হাসলেন মেয়ে। পরক্ষণেই বললেন, ‘জন্মদিনটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। একসঙ্গে সময় কাটানোটাই এখন মুখ্য। আমি মা হয়েছি। আমার মেয়ে বড় হচ্ছে। দেখা যায়, আমাদের জন্মদিনে মেয়েই সবকিছুর কেন্দ্রে থাকে।’
মেয়ে মনে করেন, জীবনে যা কিছু ভালো, সব মা–বাবার কাছে থেকে পাওয়া। ত্রপা বলেন, ‘আমার যোগ্যতা–দক্ষতা অনুযায়ী প্রাপ্তি অনেক বেশি। জীবনটা ছোট। ৫০ পূর্ণ করে বেশ কিছু চিন্তা স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষের সুস্থ থাকা জরুরি। দূরত্ব, বাগ্বিতণ্ডা ভুলে সবার সঙ্গে জীবন যাপন করে যাওয়াটাই মঙ্গল। পরিবারকে সময় দেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।’
কোনো অপ্রাপ্তি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একমাত্র অপ্রাপ্তি, যে অভিনয় দিয়ে ভক্তরা আমাকে চেনেন, সেই অভিনয়ে এখনো দেওয়ার অনেক বাকি রয়েছে। ভালো চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে চাই। এই আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।’
৮০ বছর পূর্ণ করে জীবনের এক দারুণ উপলব্ধির কথা বললেন ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ এই জীবনে আমার মধ্যে হতাশা নেই, অপ্রাপ্তি নেই। বাপের বাড়িতে অনেক বাধানিষেধে থাকতে হতো। বিয়ের পর মনে হয়েছিল, শ্বশুরবাড়িতে বাধা আসবে কিন্তু আসেনি, স্বাধীনতা পেয়েছি। আবার সন্তান জন্মের পর মনে হয়েছিল, হয়তো মেয়ের জন্য বাধা পেতে হবে। মেয়ে কোনো কিছু অপছন্দ করলে থেমে যেতে হবে। দীর্ঘ ৫০ বছরে তেমনটি হয়নি। জীবনটা আমাকে অবাক করে।’