নৌকার জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বরিশাল আওয়ামী লীগের দাপুটে হাসানাত পরিবারের অস্তিত্ব। আশির দশক থেকে একক আধিপত্যের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কর্তৃত্ব আরও টেকসই হবে, নাকি নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি হবে– সেটির ফয়সালা হবে আজ রাতে ভোটের ফলের পর। নৌকা জিতলে কোনো ‘কৃতিত্ব’ থাকবে না হাসানাত পরিবারের; হারলে পুরো দায় বর্তাবে তাদের ওপর।
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এক দশক ধরে মহানগরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাসানাতপুত্র সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এবার ভোটের মাঠে অনেকটাই অদৃশ্য হাসানাত-সাদিক। তাঁদের অনুপস্থিতি নিয়ে বরিশালের রাজনীতিতে চলছে নানা গুঞ্জন। নৌকার প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর জয়-পরাজয়ের ওপর হাসানাত পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে মনে করছে রাজনীতি সচেতন মহল।
মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ হলেন হাসানাতের ছোট ভাই। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ভাগনে ও প্রধানমন্ত্রীর ফুফাতো ভাই। পারিবারিক বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় দুই ভাইয়ের বৈরী সম্পর্ক। খায়েরকে জেতাতে মাঠে সক্রিয় বরিশাল আওয়ামী লীগে নতুন সৃষ্ট আরেকটি বলয়। তারা হাসানাত-সাদিকের কারণে বরিশালে দীর্ঘদিন কোণঠাসা ছিল বলে জানা গেছে।
তাদের অভিযোগ, খায়েরকে হারাতে নগরের বাইরে অবস্থান করে কলকাঠী নাড়ছে হাসানাত পরিবার। অনুসারীদের নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী ‘হাতপাখা’ অথবা ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীকে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কয়েক যুগের আধিপত্য ধরে রাখতেই হাসানাত পরিবার এ চক্রান্ত করছে বলে জানান বিরোধীরা।
তাঁদের মতে, আবুল খায়ের জিতলে বরিশালের রাজনীতিতে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে হাসানাত পরিবার। মেয়র পদের পাশাপাশি তিনি দলীয় পদও পেতে পারেন। এতে তাঁকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন বলয় আরও শক্তিশালী হবে। আবার আবুল খায়ের হারলেও অভিযোগের আঙুল যাবে হাসানাত পরিবারের দিকে। যার খেসারত হাসানাতকে রাজনৈতিকভাবেই দিতে হবে।
২০১৮ আর এবারের সিটি নির্বাচনে হাসানাতের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ছোট ভাইকে জেতাতে তাঁর আন্তরিকতা দৃশ্যমান হয়। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটের দিনসহ প্রচারের পুরোটা সময় নগরীর বরিশাল ক্লাবের বিশ্রামাগারে অবস্থান করেন আবুল হাসানাত। সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো নির্বাচন। সাধারণ নগরবাসীর কাছে বিষয়টি অজানা ছিল। আচরণবিধি মানার বিষয়টি দৃশ্যমান করতে তিনি সভা-সমাবেশ করেন নগরের সীমানা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার কামিনী পেট্রোল পাম্পে। এর সুফল হিসেবে রেকর্ড ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন হাসানাতপুত্র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। যদিও সকাল ৯টার মধ্যে কেন্দ্র দখল ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বর্জনের সেই নির্বাচনের ফল ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
তখনকার মন্ত্রী পদমর্যাদার হাসানাত এবারও একই পদে আছেন। এবার তিনি আচরণবিধির প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধাশীল। তপশিল ঘোষণার পর এক দিনের জন্যও তিনি নগরীতে যাননি। নগর থেকে ৫০ কিলেমিটার দূরে আগৈলঝাড়ার সেরালে অবস্থান করে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনকেন্দ্রিক দলের বিশেষ বর্ধিত সভা করেছেন নগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে গৌরনদী পৌর মিলনায়তনে। মনোনয়ন নিশ্চিত করতে গত ৪ এপ্রিল ঢাকায় যাওয়া মেয়র সাদিক এ পর্যন্ত ফেরেননি নগরীতে। যদিও সাদিককে বরিশালে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন খোকনপন্থিরা। ২৬ মে বিশেষ বর্ধিত সভার আগ পর্যন্ত হাসানাত পরিবার অনুসারীরা নির্বাচন কার্যক্রমে যুক্ত হননি। যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁরাও খোকনপন্থিদের সন্দেহের চোখে রয়েছেন।
এ ব্যাপারে শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দিন মোহন বলেন, ‘কয়েক যুগের দাপুটে হাসানাত এখন উভয় সংকটে আছেন। নৌকা জিতলে বরিশাল আওয়ামী লীগে নতুন সূর্যোদয় হবে; হারলে তার দায় কোনোভাবেই হাসানাত এড়াতে পারবেন না। এ জন্য তাঁকে দলীয় সভাপতির কাছে জবাবদিহি করতে হতে পারে।’ তিনি জানান, নৌকাকে হারানোর জন্য হাসানাত অনুসারীদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। নৌকায় ভোট না দিতে নগরের বিভিন্ন স্থানে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ এখনও তাঁরা পাচ্ছেন।