শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ চাওয়ার ব্যাপারে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে ব্লুমবার্গ বলেছে, ‘নির্বাচনে ভোট না পাবার ভয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক নেতারা প্রায়ই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন করতে দ্বিধা প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের থেকে ব্যতিক্রম।‘
‘আইএমএফ-এর শর্তাবলি দ্রুত বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেখানে জ্বালানী ভর্তুকি বিষয়ে আইএমএফ-এর নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করতে পারায় এখনও আইএমএফ বেইলআউট পায়নি পাকিস্তান। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা তাদের স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনের তারিখ পিছিয়েছে। কারণ, আইএমএফের ঋণ পেতে গত সপ্তাহেই তারা তাদের কর এবং সুদের হার বাড়িয়েছে। গতবছর জুলাই মাসে আইএমএফ-এর কাছে ঋণ চাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম সবার শেষে এলেও আইএমএফ-এর কঠোর নির্দেশাবলি দ্রুত পূরণের ফলে বাংলাদেশের ঋণই সর্বপ্রথম অনুমোদিত হয়।’
বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের বিষয়ে মন্তব্য করে, ‘ব্লুমবার্গ বলেছে, ২০২৪-এর জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে শেখ হাসিনা বিজয়ী হবেন বলে ব্যাপকভাবে আশা করা হচ্ছে – যার অন্যতম কারণ তার বিরোধীদের বেশিরভাগই হয় কারাগারে না হয় আইনি মামলায় জর্জরিত।‘
তবে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এবং সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি দেশের মানুষের অসন্তুষ্টির কথা বললেও, উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান ব্লুমবার্গকে বলেন, ক্ষমতাসীন দল যদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তবে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব এবং এই সংকট সফলভাবে সামাল দেয়ার যোগ্যতা শেখ হাসিনার অবশ্যই রয়েছে।
শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে এখনো দেশের ভেতরে ও বাইরে ষড়যন্ত্র চলছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের পাশাপাশি ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এমন সুরে কথা বলতে দেখা যায় যা যেকোনো দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমেরিকানরা বারবার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। অবশ্য আমরাও আমাদের দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তবে আমাদের বাইডেন প্রশাসনের সদস্যদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, তাদের নিজেদের দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ইতিমধ্যেই গুরুতর বিতর্কের মধ্যে। ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
ঢাকায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত যখনই মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন, তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে, তাদের রাষ্ট্রপতি এবং বাইডেন পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বারবার অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেনকে জয়ী করতে কিভাবে ফেডারেল এজেন্সিগুলি জনমতে হস্তক্ষেপ করেছিল এবং বাইডেন ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দুর্নীতি ও অপরাধের তথ্য লুকিয়েছিল তা ইতিমধ্যেই টুইটারের মালিক ইলন মাস্কের হাতে ধরা পড়েছে।
ব্লুমবার্গের মতে, ‘শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আইএমএফ-এর কাছে যাওয়া দেশের জনগণ এবং ভোটারদের আস্থা অর্জনের একটি কৌশল ছিল যা প্রমাণ করে যে তিনি ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশকে শ্রীলঙ্কার মত ঋণ খেলাপির হওয়া থেকে ফিরিয়েছেন। পাকিস্তানও খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনার সম্মুখীন। মূলত ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে গত বছর দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি সংকট এবং আমদামি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্য ঘাটতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং রিজার্ভ তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে গিয়েছিল।‘
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর “সপ্তাহের মধ্যে” বাংলাদেশেরও একই পরিণতি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টি সহ বাংলাদেশের প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকর সিদ্ধান্ত ও প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশের সেই পরিণতি হয়নি।
তবে এটি লক্ষ্যনীয় যে, যেখানে বাংলাদেশ গত ১৪ বছর যে ৬ শতাংশের বেশি বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে, এটি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে আগামী বছরগুলিতে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হতে পারে।
এই মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে বেশিরভাগ খাত থেকে ভর্তুকি কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মত সমস্ত সংস্থার বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করতে হবে যারা বছরের পর বছর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছে। সেইসাথে সরকারের উচিত ‘কুইক রেন্টাল পাওয়ার’ প্রকল্প সহ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করা এবং এর বিকল্প উপায় খুঁজে বের করা। উদাহরণ স্বরূপ বড় পুকুরিয়ায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, অন্তত আরও দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সৌরবিদ্যুতের উপর জোর দেওয়া।
সবচেয়ে বড় কথা- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং যারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শেখ হাসিনার জন্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এটি অবিলম্বে হওয়া উচিত।