অনিশ্চয়তায় বিএনপির সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল। অন্যদিকে গঠনতন্ত্রের বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্বাহী কমিটির সভা করতে পারছে না দলটি। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার এ বৈঠকের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে মাত্র একবার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোনো বর্ধিত সভা করতে পারেনি দলটি। এতে দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক তৎপরতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দলের কার্যক্রমে সমন্বয় নেই। দল পরিচালনায় তৃণমূলের সঙ্গে কোনো আত্মিক সম্পর্ক গড়তে পারছে না হাইকমান্ড। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো দায়বদ্ধতাও তৈরি হচ্ছে না।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এর সাড়ে চার মাস পর দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান আর নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য নিয়ে প্রায় ৫৯৪ সদস্যের বিশাল কমিটি করে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার আগে ৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় খালেদা জিয়া দলের নেতাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে যান, যাতে তার অবর্তমানে দলের মধ্যে কোন্দল বা বিভ্রান্তি তৈরি না হয়। ওয়ান ইলেভেনের সময়কারের মতো দলে ভাঙনের সৃষ্টি না হয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর আগে কিংবা পরে নির্বাহী কমিটির কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে দল পরিচালনায় সবাইকে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে পারছে না হাইকমান্ড। এমনকি দলের সম্পাদকমণ্ডলী থেকে শুরু করে নির্বাহী সদস্যদের কার্যক্রমের মনিটরিং কিংবা কৈফিয়তের কোনো ব্যবস্থাও তৈরি হচ্ছে না।
নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলে দ্রুত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা উচিত। নিষ্ক্রিয়দের তালিকা করে বাদ দিয়ে দুঃসময়ের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের নির্বাহী কমিটিতে জায়গা দেওয়া উচিত। নইলে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন হোঁচট খাবে। দলও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দলের নেতারা বেশি কমিটি করেন, কিন্তু কেউ সংগঠন করেন না। একটি কমিটি মানেই সংগঠন না। আর নেতৃত্বের যেখানে দুর্বলতা দেখা হয়, সেখানে বহুজনের কমিটি হয়। কমিটিতে যখন যুগ্ম আহ্বায়কের সংখ্যা বেশি থাকে তখনই বুঝতে হবে, কেউ কাউকে মানেন না।
তার মানে অঙ্গীকারের অভাব। সংগঠনের চেয়ে নিজেকে সবাই বড় মাপের নেতা মনে করেন। দলের উপদেষ্টা-সম্পাদক বেশি, কর্ম সম্পাদকটা একটু কম।
দলের গঠনতন্ত্রের ১১ (চ) ধারায় বলা হয়েছে- প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রয়োজনবোধে যে কোনো সময় কমিটির সভা চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে ডাকা যেতে পারে। যে বছর জাতীয় কাউন্সিল হবে, সে বছর ছাড়া প্রতি বছর অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিংহভাগ নেতাই নিষ্ফ্ক্রিয়। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকরা কোনো কাজই করছেন না। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে হাজিরা দিয়েই অনেকে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন। আর বেশিরভাগ নেতাই পদ-পদবি বাগিয়ে চুপচাপ। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি ছয় মাস অন্তর নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলে এসব নেতার কার্যক্রম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। তাদের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন দল পরিচালনা হচ্ছে শুধু গুটিকয়েক নেতার শ্রম, মেধা আর আন্তরিকতার ওপর ভর করে। এভাবে বেশিদূর যাওয়া যায় না। তাই বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা আয়োজনের দাবি ক্রমশই প্রবল হচ্ছে। দলীয় ফোরামের ভেতরে ও বাইরে এ বিষয়ে কথা বলছেন অনেকে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠানের পক্ষে দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দলের সিনিয়র নেতারাই এ দাবি করতে থাকেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ আরও বেশ কিছু বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার জন্য তারা এ সভা আয়োজনের কথা বলছেন। এর বাইরে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে আর জাতীয় সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে দলে পাঁচ এমপির সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীদের মধ্যে আরও বেশি বিভ্রান্তি দেখা যায়।
দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন নেতা বলেন, মামলা-হামলায় বিপর্যস্ততার কারণে অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এটা কোন অজুহাত হতে পারে না। সময়ের কাজ সময়মতো করতে হয়। তবে খালেদা জিয়া অথবা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে নির্বাহী কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ সভায় তৃণমূলের রাগ, ক্ষোভ, দুঃখের বিস্ম্ফোরণ ঘটতে পারে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তাকে মুক্ত করার কোনো পথ না বের করে, রাজপথের আন্দোলনে না গিয়ে সংসদে যাওয়ায় নেতাকর্মীদের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সব প্রশ্ন একই সঙ্গে বিস্ম্ফোরণ হলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে সিনিয়র নেতারাও আঁচ করতে পারছেন। এ কারণেই তারা নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠানে তেমন আগ্রহী নন।
দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নির্বাহী কমিটির সভা হচ্ছে না কেন- এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বলতে পারবেন। কিন্তু হওয়া উচিত।