আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশে পুরোপুরি ভর্তুকি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেনি। সংস্থাটির ঢাকা সফররত মিশন গত কয়েক দিনে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছে, এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিশেষত তাদের খাদ্য সহায়তায় সরকারকে বাজেট থেকে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে এ ভর্তুকি হতে হবে ক্ষণস্থায়ী এবং লক্ষ্যনির্দিষ্ট। ধনী-গরিব সবাইকে নির্বিশেষে ভর্তুকি দিয়ে বাজেটকে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থিক ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ভারসাম্য রক্ষায় রাজস্ব বা আর্থিক নীতি এবং মুদ্রানীতিকে একই পথে চলতে হবে। দুই নীতির মধ্যে যথাযথ সমন্বয় থাকতে হবে। আইএমএফ চায়, দুটি নীতিই এই মুহূর্তে সংকোচনমূলক থাকুক। কারণ আগে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খাদ্য ও কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে সংস্থাটির তেমন আপত্তি নেই। জ্বালানি খাতেও সব ভর্তুকি একবারেই তুলে দিতে হবে- ঋণের জন্য এমন শর্তের কথাও তাঁরা বলেননি। আইএমএফ চায়, ভর্তুকি দেওয়া হোক অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে, যারা সরকারি সহায়তা ছাড়া এই মুহূর্তে বড় সংকটে পড়ে যাবে। তারা ভর্তুকির পদ্ধতিতে সংস্কার চেয়েছে। সরকারি সহায়তা যারা পায়, তাদের তালিকা করার ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতা চেয়েছে।
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা, বাজেট সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে ঢাকায় রয়েছে। তারা ইতোমধ্যে সরকারের সংশ্নিষ্ট প্রায় সব সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে। কাল থেকে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে তারা। আগামী ৯ নভেম্বর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বিবৃতি দেবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়, যা এর আগের অর্থবছরের প্রকৃত খরচের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, পণ্যের সরবরাহ সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধীরগতির কারণে সরকার আমদানিতে লাগাম টানা, পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় কমানোসহ কৃচ্ছ্র সাধনের কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় গত আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়। তেলের দাম বাড়ানোর পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে কিনা- তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এমন নীতিই অনুসরণ করছে। কয়েক দফায় নীতি সুদহার (রেপো) বাড়ানো তার প্রমাণ। তবে এ বিষয়ে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণ হলো, সুদের হারে সীমা আরোপ রেখে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে সামগ্রিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মূল্যস্ম্ফীতি যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী, সেহেতু সুদের হার বাজারভিত্তিক হতে হবে। কেননা ভোগ্যপণ্য ক্রয় কিংবা ব্যক্তিগত ঋণ তুলনামূলক সস্তা থাকলে চাহিদা দমন করা যাবে না। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ের পদক্ষেপ যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা নিবিড়ভাবে তদারকির পরামর্শ দিয়েছে প্রতিনিধি দল। তারা বলেছে, উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করার ঘোষণা কার্যকর হচ্ছে কিনা- তা নিয়মিত পর্যালোচনার মধ্যে রাখতে হবে। পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। রাজস্ব নীতি এবং মুদ্রানীতি- দুটিকেই এই মুহূর্তে সংকোচনমূলক রাখতে হবে।
আইএমএফের এসব পরামর্শের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিষ্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক রাখা দরকার। তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে বাজেট ঘাটতি যাতে না বাড়ে সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। রাজস্ব বাড়িয়ে এবং প্রয়োজনে কিছু জায়গা থেকে ভর্তুকি কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে জরুরি আমদানির জন্য ইতোমধ্যে রিজার্ভ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। সব আমদানিই এই মুহূর্তে জরুরি ছিল কিনা- তা পর্যালোচনার দরকার রয়েছে।
ভর্তুকি কোথায় সমন্বয় করা যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কভিডের সময় ভর্তুকি সুদে ঋণ দেওয়ার যে কার্যক্রম শুরু হয়, তা এখনও বহাল আছে। এ ভর্তুকির আওতায় শুধু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান রেখে মাঝারি এবং বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। বিনিময় হার মোটামুটিভাবে বাজারভিত্তিক হওয়ায় ডলারের দর অনেক বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের ওপর ভর্তুকি তুলে দেওয়া যেতে পারে। রপ্তানির বিভিন্ন খাত বহু বছর ধরে ভর্তুকি পাচ্ছে। এখানে কিছু সংস্কার আনা যেতে পারে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের বিদ্যুৎ ব্যবহারে ভর্তুকি দেওয়ার কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ব্যবহার হলে সেখানে ভর্তুকি তুলে দেওয়া যেতে পারে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে লক্ষ্যনির্দিষ্ট ভর্তুকি দেওয়া জটিল বিষয়। তারপরও কৃষি কার্ডের মতো কোনো ব্যবস্থা করে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি তেল দেওয়া যেতে পারে। তবে কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়। মূল কথা, ভর্তুকির উদ্দেশ্য থাকতে হবে সামাজিক সুরক্ষার। সবাইকে ভর্তুকি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখন অর্থনীতির নেই।
আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতিকে কতটা স্বস্তি দেবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশ যে ৪৫০ কোটি ডলার চেয়েছে, সেটি একসঙ্গে পাবে না। পর্যায়ক্রমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হবে। এটি আবার ব্যয় মেটানোর সঙ্গে জড়িত। এই অবস্থায় ৪৫০ কোটি ডলার পেলে বাংলাদেশের তিন-চার মাসের বৈদেশিক ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। আমদানি ব্যয় মেটানোর পরিপ্রেক্ষিতে এই ঋণ হয়তো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না-ও হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিলে এই ঋণের গুরুত্ব রয়েছে। এই ঋণ অর্থনীতিতে একটি স্বস্তি আনবে। অর্থনীতির বিভিন্ন অংশীজন বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করবে। ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য অর্থায়নের বাধাও দূর হবে। পাশাপাশি আইএমএফের ঋণ তুলনামূলক কম সুদে পাবে বাংলাদেশ। এতে ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হবে। বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হবে। সার্বিকভাবে আইএমএফের ঋণের ইতিবাচক প্রভাব নানাভাবে অর্থনীতিতে পড়বে।
রিজার্ভের সংকট কাটাতে এবং বাজেট সহায়তার জন্য এই ঋণ নিতে হবে। অর্থনীতির বড় সংকট এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আইএমএফের ঋণের সুদের হার কম এবং এটা দীর্ঘমেয়াদি। ফলে এর চাপ কম হবে, কিন্তু রিজার্ভের ঘাটতি কমাতে সহায়ক হবে।