একটি শিরোপার জন্য আর্জেন্টিনার অপেক্ষা বহু বছরের। লিওনেল মেসির অপেক্ষাটা আরও বড়। এক জীবনে ফুটবল ক্যারিয়ারের যা জেতার সব জিতেও একটি সোনালি ট্রফির জন্য ক্যারিয়ারজুড়ে অপূর্ণতা ভর করেছিল তাঁর। মরুর বুকে ধুয়েমুছে গেল সব অপূর্ণতা।
এ যেন নিয়তিরই লিখন ছিল। লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ যাবে, সেটা যেনতেনভাবে না। নাটকের পর নাটক, স্নায়ুর চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে সম্ভবত বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য চিত্রনাট্যের সমাপ্তিটা হবে মেসির হাতে ট্রফি ওঠার মধ্য দিয়ে। যে ট্রফি দিয়ে ফুরিয়েছে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের বিশ্বজয়ের অপেক্ষা। কে জানে হয়তো এর মধ্যে দিয়ে শেষ হবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার নিয়ে বিতর্কটাও। যে অধরা ট্রফিটা ছিল না বলে মেসিকে সেরা মানতে রাজি ছিলেন না অনেকে, আজ রাজ থেকে সেই ট্রফিটা যে শুধুই মেসির।
লুইসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে মূল লড়াইয়ের প্রথমার্ধ বিশ্ব দেখল আর্জেন্টিনার দাপট। কি বল দখল, কি আক্রমণ—আর্জেন্টিনার দাপট ছিল সর্বত্র।
পুরো ম্যাচে ৫৪ ভাগ সময় বল দখলে রেখে ২০বার আক্রমণে যায় আর্জেন্টিনা। যার মধ্যে অনটার্গেট শট ছিল ১০টি। অন্যদিকে ম্যাচের প্রথমার্ধে একবারও আক্রমণে যেতে না পারা ফ্রান্স বাকি সময়ে ১০ বার আক্রমণে যায়। তাতেই বাজিমাত হয়ে যায়। ম্যাচ সমতায় ফিরিয়ে নাটক জমিয়ে দেয়। কিন্তু টাইব্রেকারে গড়ালে আর্জেন্টিনার সামনে পেরে ওঠেনি ফরাসিরা।
৪-৪-২ ফরমেশনে মাঠে নামা আর্জেন্টিনা ম্যাচের শুরু থেকেই ছিল আক্রমণাত্মক। আক্রমণে উঠে পঞ্চম মিনিটে নেয় প্রথম শট। তবে অ্যালিস্টারের নেওয়া শট ঠেকিয়ে দিতে ভুল করেননি হুগো লরিস। ১৭তম মিনিটে সুযোগ হাতছাড়া করেন ডি মারিয়া। প্রতিপক্ষের ডি বক্সে বল পেয়ে তিনি মারলেন ক্রসবারের অনেক উপর দিয়ে।
তবে গোলের অপেক্ষা দীর্ঘ হয়নি আর্জেন্টিনার। ম্যাচের বয়স তখন ২১ মিনিট। প্রতিপক্ষের ডি বক্সে বল নিয়ে ঢুকে যান ডি মারিয়া। কিন্তু ওই মুহূর্তে ডি মারিয়াকে পেছন থেকে ফাউল করে বসেন উসমান দেম্বেলে। পেনাল্টির সুযোগ পেয়ে যায় আর্জেন্টিনা।
পেনাল্টির সুযোগ হাতছাড়া করেননি লিওনেল মেসি। সফল স্পট কিকে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেন অধিনায়ক। এবারের বিশ্বকাপে এটি মেসির ১২তম গোল। স্পর্শ করলেন ফুটবল কিংবদন্তি পেলেকে। গোল করায় তাঁদের চেয়ে এগিয়ে কেবল আর চারজন।
এগিয়ে যাওয়ার আমেজ শেষ না হতেই ফের গোল উৎসব। এবার পেনাল্টি নয়, নায়ক বনে যান কোপা আমেরিকা জেতানো ডি মারিয়া। ম্যাচের ৩৬ মিনিটে ডি মারিয়ার পা থেকে আসে পরের গোলটি। এখানেও আছেন মেসি। মাঝমাঠে থেকে বল এগিয়ে দেন তিনি। পাস পেয়ে আলভারেজ বাড়ান ম্যাক অ্যালিস্টারকে। তাঁর পাস বক্সে বাঁ দিক থেকে চোখ ধাঁধানো শট নেন ডি মারিয়া। ফ্রান্স গোলকিপার হুগো লরিসের ফ্রান্স গোলকিপার হুগো লরিসের কিছুই করার ছিল না।
২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। বিরতি থেকে ফিরেও আক্রমণে দাপট ছিল তাদের। কিন্তু শেষ ১০ মিনিটে খেলা ঘুরিয়ে দিলেন এমবাপ্পে। ৮০তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে করলেন প্রথম গোল, পরের মিনিটেই দিলেন দ্বিতীয় গোল। তাতেই এলোমেলো হয়ে যায় আর্জেন্টিনা।
দ্বিতীয়বার জালে বল পাঠিয়ে টুর্নামেন্টে সপ্তম গোল স্পর্শ করেন এমবাপ্পে। মেসিকে ছাপিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে যান তিনি। ফ্রান্স সমতায় ফিরলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে জমে ওঠে লড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত্র ত্রাতা হলেন সেই মেসিই। লুইসাল স্টেডিয়াম দেখল তাঁর বা পায়ের জাদু। ১০৮তম মিনিটে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন রেকর্ডবারের বর্ষসেরা ফুটবলার। এরপর আবারও দৃশ্যপটে এমবাপ্পে। এবার পেনাল্টি থেকে তুলে নেন হ্যাটট্রিক। ম্যাচের স্কোর দাঁড়ায় ৩-৩। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেই জয়ের হাসি হাসে আর্জেন্টিনা।