সিমিন হোসেন রিমি
বৈশাখের প্রচণ্ড গরম। গভীর রাত। টিনের চালে বৃষ্টির টুপটাপ রিমঝিম শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সিস্টার ক্যাথরিন গনজালভেসের। মনে হলো, খুব বোধ হয় বেশি দেরি নেই ভোর হতে। একটু তন্দ্রা নিয়েই বিছানায় শুয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই মূল ফটক থেকে ভেসে আসতে থাকে মানুষের কণ্ঠস্বর। দরজা খোলেন, দরজা খোলেন! খুব জরুরি।
একই সঙ্গে দরজায় মানুষের হাতের ধাক্কার আওয়াজ। সিস্টার দ্রুত উঠে বাইরে আসেন। ফাদার ফ্রান্সিস তাঁর ব্যাগসহ সামনে দাঁড়ানো। তিনি দূরে আরেক পাড়াগাঁয়ে যাবেন কোনো অসুস্থ মানুষের শুশ্রূষায়। খ্রিষ্টান এই মিশনে আরও যাঁরা থাকেন, প্রায় সবাই গির্জার সামনের উঠানে বেরিয়ে এসেছেন মানুষের শব্দ শুনে।
ফাদার ফ্রান্সিস দরজা খুললেন। সবাই পরিচিত মুখ এ পাড়ারই। আওয়ামী লীগের সমর্থক তরুণ যুবক কয়েকজন। দ্রুত বলে ফেলে, ‘আমরা শুনেছি, এই ভবেরপাড়া গ্রামে আজ সকালে যেকোনো সময় বড় কোনো অতিথি আসবেন। আমাদের তো কিছু নেই, কী করে তাদের বরণ করব? তখন মনে হলো সিস্টার আপনার কথা। কী সুন্দর আপনার হাতের লেখা। এতিম শিশুদের কত কিছু তৈরি করে দেন আপনি। সান্তা ক্লজ তৈরি করেন কাপড় আর তুলা দিয়ে। আমাদেরও কাপড়ে কিছু লিখে দিতে হবে এখুনি। কারণ, জানি না তো কারা সেই মহান অতিথি, এসেই–বা পড়বেন কখন? চেয়ারও চাই কিছু। কারণ, ভবেরপাড়ায় এই মিশন ছাড়া আর তো কোনো বাড়িতে চেয়ার নেই।
ফাদার ফ্রান্সিস আশ্বস্ত করেন তাঁদের। তিনি সেই অন্ধকারে বেরিয়ে পড়েন ঈশ্বরের সেবায়। অর্থাৎ, অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষায়। দায়িত্ব নেন সিস্টার ক্যাথরিন। বড়দিনের সময়ে রাখা লাল এক টুকরা বাড়তি কাপড় রাখা ছিল। ছেলেদের কথামতো লিখলেন ‘জয় বাংলা’। লিখলেন ‘স্বাগত’। লেখার উপর তরল আঠা দিয়ে তুলার অক্ষরগুলো লাগালেন, তুলা খুলে যেন না যায়, সুইসুতা দিয়ে কিছু বোতাম আটকে দিলেন। ছেলেরা তো মহাখুশি।
এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ সেদিন। রাতের একপশলা বৃষ্টির পর সূর্য আলো ছড়িয়েছে এলাকাজুড়ে। তাঁরা কেউ জানেন না অসম্ভব এক ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে এই ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে। মিশন থেকে সব চেয়ার নিয়ে রাখা হচ্ছে। একটা মঞ্চও লাগবে। কাছাকাছি দুই বাড়ি থেকে দুটি চৌকি আনা হলো, হয়ে গেল দারুণ মঞ্চ। ‘জয় বাংলা’, ‘স্বাগত’ লেখাটি সযত্নে পাটের দড়ি দিয়ে ঝুলানো হলো আমগাছের ওপর, যেন সবার নজরে পড়ে।
এভাবেই অজান্তেই সৃষ্টি হতে থাকল ইতিহাস। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারির মাধ্যমে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ হলো। এই অনাড়ম্বর আন্তরিক ভালোবাসাপূর্ণ শান্ত নিবিড় এক পরিবেশে। উপস্থিত ছিলেন দেশি–বিদেশি বহু সাংবাদিক বন্ধুরা। সাক্ষী রইলেন হাজারো স্থানীয় মানুষ। হিন্দুধর্মাবলম্বী এক বাড়ি থেকে আনা হারমোনিয়ামে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করলেন আমাদের দেশের, অর্থাৎ ভবেরপাড়ার স্থানীয় ছেলেরাই।
গার্ড অব অনার দিলেন স্থানীয় আনসার পুলিশের সদস্যরা। এর নেতৃত্বে ছিলেন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ। এভাবেই সব ধর্মের মানুষের একত্রিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। তিনি তখন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী, তাই উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের, ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং হাজারো মানুষের জনতার সামনে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করলেন ‘মুজিবনগর’।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নূতন জাতি জন্ম নিল। .. আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য।’ (সূত্র: একাত্তর রণাঙ্গন, শামসুল হুদা চৌধুরী)
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণে তুলে ধরলেন পাকিস্তনি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ ও প্রাণঘাতী যুদ্ধের বিরুদ্ধে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা। তুলে ধরলেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তী সব কর্মকাণ্ড। বললেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন–পালন করেছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না।’