শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর জন্মদিন আজ। ১৯৫২ সালের আজকের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।হুমায়ুন ফরিদীর ক্যারিয়ার শুরু মঞ্চ থেকে। এরপর ছোটপর্দা, তারপর বড়পর্দা। সব জায়গায় তিনি ছড়িয়েছেন দ্যুতি। তিনি তার নান্দনিক অভিনয় নৈপুণ্যে হয়ে ওঠেন গুণীদের একজন। তিনি তার অভিনয়ে বরাবরই প্রবেশ করতেন গভীরে। তাইতো কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়ের শুরুটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলে থাকতেন এ অভিনেতা। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের নজরে পড়েন তিনি। এরপর যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের নাট্যচর্চার সঙ্গে। ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চে অভিনয় করেন কিত্তনখোলা, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি, কেরামত মঙ্গল, ধূর্ত উই প্রভৃতি নাটকে। কেরামত মঙ্গল নাটকে কেরামত চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় এখনও আলোচিত হয় ঢাকার মঞ্চে।
টিভি নাটকে হুমায়ুন ফরীদি আলোচনায় আসেন শহিদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। নাটকটিতে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসা অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি ছোটপর্দায় সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক ‘শকুন্তলা’, ‘ফণীমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ১৯৯০ সালে নিজের পরিচালনায় ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় ফরীদির ঢাকা থিয়েটারের জীবন।
আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরীদির অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। তাঁর অন্য নাটকগুলোর মধ্যে ছিলো ‘সংশপ্তক’, ‘হঠাৎ একদিন’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘নীল নকশার সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘কাছের মানুষ’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মোহনা’, ‘ভবেরহাট’, ‘জহুরা’, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ ইত্যাদি।
ফরীদির প্রথম সিনেমায় অভিনয় শুরু হয় তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’র মধ্য দিয়ে। এরপর, তাঁর অভিনীত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’, ‘আঞ্জুমান’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ প্রমুখ। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
হুমায়ুন ফরীদি নামের দুই অংশের মধ্যে শেষেরটির বানানকে অদ্ভুত বলেছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। তার মতে, ফরীদি বানানটি হওয়ার কথা ছিল ‘ফরিদী’। কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে ফরীদি।
এ নিয়ে হুমায়ুন ফরীদি বলেছিলেন, ‘এর বিশেষ কোনো কারণ নেই। লেখার সুবিধার্থে ফরীদি বানানটি এমন।’
তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা জানিয়েছিলেন, ফরীদি নামটি তার মায়ের নামের অংশ থেকে নেয়া। ফরীদির মায়ের নাম ফরিদা ইসলাম। ফরিদা শব্দটিই হুমায়ুনের সঙ্গে ফরীদি হয়ে যুক্ত হয়েছে।
মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফরীদি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতো স্নিগ্ধ আর গভীর সুন্দর আর কিছু নাই।’
তাই হয়তো ফরীদির মৃত্যু শোক কাটিয়ে প্রকৃতি ভরে ওঠে বসন্তের রঙে। মানুষের মনেও জেগে ওঠে ভালোবাসার গভীর অনুভূতি।
প্রেমে নাকি অনেক বার পড়েছিলেন ফরীদি। তিনি মনে করতেন, প্রেমে পড়ার মতো আনন্দনায়ক বিষয় পৃথিবীতে আর কিছু নেই; প্রেমের মতো ভালো বিষয়ও মানব ইতিহাসে আর নেই। তার কাছে প্রেম হলো স্বর্গীয়।
প্রেমে পড়ার অনুভূতি জানতে চাইলে ফরীদি বলেছিলেন, ‘প্রেমে পড়লে মনে হয় যেন পেটের ওপর প্রজাপতি নাচছে। সুড়সুড়ির মতো কিছু একটা। এটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
ভালোবাসা নিয়ে ফরীদির একটি উক্তি বেশ জনপ্রিয়। সেটি হলো, ‘কাউকে ভালোবাসলে এক বুক সমুদ্র নিয়ে ভালোবাসতে হবে। তা না হলে সেই প্রেমের কোনো অর্থ নাই।’
ফরীদির প্রসঙ্গ এলেই চলে আসে দেশের আরেক বরেণ্য অভিনয়শিল্পী তার সাবেক স্ত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার কথা। সুবর্ণার সঙ্গে অমিলের কোনো জায়গা খুঁজে পাননি ফরীদি। তবুও একসঙ্গে থাকা হয়নি তাদের।
সুবর্ণাকে নিয়ে ফরীদি বলেছিলেন, ‘সুবর্ণা মানুষের মতো চিন্তা করে, মেয়েদের মতো না।’প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ ছিলেন ফরীদি। সেই আশার কথা অনেক জায়গাতেই বলেছেন তিনি।
‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন, আমাদের বঙ্গবন্ধু আছেন, পদ্মা আছে, মেঘনা আছে, কাজ করার মানুষ আছে। আমরা এগিয়ে যাবই।’সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার কবিতাটি খুব পছন্দ করতেন ফরীদি।
কবিতার কয়েকটি লাইন হলো
‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর
ফুসফুস-ভরা হাসি…
তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়…।’
কবিতার মতো ফরীদি তার যা কিছু আছে, সব দিয়ে যেতে চেয়েছেন তার পরবর্তী সময়কে।