সীমান্তের দীর্ঘ গোপন সুড়ঙ্গপথ। রাতের আঁধারে এই সুড়ঙ্গ টর্চলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। জমজমাট হয় চোরাকারবারিদের কারবার। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় সীমান্তে এমন আয়োজন করেই রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে কয়লা চোরাকারবারিরা। দুঃসাহসিকভাবে সীমান্তে সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভারত থেকে বস্তায় বস্তায় কয়লা আনছে। ওপারের পাহাড় খুঁড়ে কয়লা আনতে গিয়ে ঘটছে একের পর এক প্রাণহানি।
অবৈধভাবে এসব কয়লা ঘিরে তাহিরপুরে একটি বড় সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সুড়ঙ্গে ঢোকে। ওপাশে গিয়ে পাহাড় খুঁড়ে কয়লা সংগ্রহ করে। কপালে টর্চলাইট বেঁধে মাথা নিচু করে কয়েকশ ফুট সুড়ঙ্গপথ তারা পাড়ি দেয়। এরপর কয়লার বস্তা পাহাড় থেকে বাংলাদেশের সীমানায় ফেলে দেয়। আবার কখনও মাথায় করেও নিয়ে আসে তারা। অবৈধ এমন কাজ করতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে কেউ কেউ মারা যায়। আবার মাটি বা পাথর চাপা পড়েও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত সোমবার এমন কৌশলে কয়লা আনতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন দু’জন। গত ছয় মাসে তাহিরপুর এলাকায় সব মিলিয়ে প্রাণ গেছে পাঁচজনের।
সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের এপারে কাঁটাতারের বেড়া নেই। বিজিবির টহল দলকে ফাঁকি নিয়ে অনেকে সুড়ঙ্গ দিয়ে ওপারে কয়লা আনতে যায়। নির্দিষ্ট বাহিনী দিয়ে এসব বন্ধ করা কঠিন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবার সহযোগিতা দরকার। আর সীমান্তের বাসিন্দাদের মানসিকতাও একটু ভিন্ন থাকে।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট রঞ্জিত সরকার বলেন, অনেকে অধিক লাভের আশায় সুড়ঙ্গ দিয়ে কয়লা আনতে যায়। একেকজন শ্রমিক একরাতে দু-তিন হাজার টাকা পাচ্ছে। এই বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য প্রশাসনকে একাধিকবার বলেছি। সবার সহযোগিতায় এটা বন্ধ করব।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাহিরপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয়ের বড়ছড়া এলাকা, তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকা বুরুঙ্গাছড়া, লাকমা, লালঘাট, চারাগাঁও, জঙ্গলবাড়ি ও কলাগাঁওয়ে বৈধ কয়লার কারবার রয়েছে। তবে চোরাকারবারিরা কৌশলে প্রতি রাতে টনে টনে অবৈধভাবে কয়লা এনে বৈধ ব্যবসায়ীদের ডাম্পে মিশিয়ে দেয়। প্রতিদিন সীমান্তের সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দিয়ে কয়েকশ লোক জীবন হাতে নিয়েই ওপারে যায়। এরপর তারা কয়লা ও পাথর সংগ্রহ করতে থাকে।
লাকমা গ্রামের বাসিন্দা মোশাহিদ আলম জানান, গত সোমবার সন্ধ্যায় খায়রুল ও মোখলেছ তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে টেকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির পেছন দিয়ে সীমান্তের ওপারে কয়লা আনতে যান। রাত সাড়ে ১০টায় কয়লা খনিতে প্রবেশ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা। পরে অচেতন অবস্থায় তাহিরপুর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তারা মারা গেছেন।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, সীমান্তের ওপারে ভারতের ভেতরে বেশকিছু পাহাড় রয়েছে। সেখানে কয়লা ও পাথর পাওয়া যায়। যারা অবৈধভাবে ওপারে যায় তারা মূলত কয়লা ও পাথরকে টার্গেট করে। অনেক সময় মাটিমিশ্রিত কয়লা নিয়ে আসে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বৈধ পথে দিনে গড়ে ২০০ ট্রাক কয়লা দেশে আসে। এতে প্রায় ২ হাজার ৪০০ টন কয়লা এপারে আসছে। অন্যদিকে অবৈধ পথে ৭০০ থেকে ৮০০ টন কয়লা আসে প্রতি রাতে। প্রতি বস্তা চোরাই কয়লা বিক্রি হয় ৭০০ টাকায় এবং প্রতি টন বিক্রি হয় ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকায়। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আর একটি সুবিধাভোগী গ্রুপ ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছত্রছায়ায় এসব কারবার চলছে।