দেশে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে নব্য ও পুরোনো জেএমবি বলতে গেলে এখন নেতৃত্বশূন্য। আনসার আল ইসলামের (সাবেক এবিটি) নেতৃত্বে রয়েছেন মেজর (বরখাস্ত) জিয়া। অন্যদিকে এক সময়ের দুর্ধর্ষ হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজিবি) অবস্থা মৃতপ্রায়। তাদের নেতাকর্মী প্রায় সবাই ভিড়েছে অন্য জঙ্গি সংগঠনে।
সক্রিয় উগ্রপন্থিরা এখন কাজ করছে ‘সাইবার লিডারশিপে’। দৃশ্যমান কোনো নেতা নয়; ভার্চুয়াল জগতে একেক সময় একেকজন নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের।
জঙ্গিদের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, হুজিবি অধিকাংশ সময় কোনো না কোনো ‘শক্তির’ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। অনেক দিন এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ রয়েছে। তাই হুজিবি আর সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এমন কোনো আলামতও নেই যে, এরা নিকট ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, হুজিবি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। এক সময় এই সংগঠনটি তৎকালীন সরকারের কোনো বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। ২০০৬-০৭ সালের পর থেকে এই ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় হুজিবি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আবার এই সংগঠন উগ্রবাদে বিশ্বাসী তরুণদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, অনলাইনে উগ্রপন্থিরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশে তারা সুবিধা করতে পারছে না। অনলাইনে রিক্রুট করে সেভাবে কাউকে সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত করতে পারেনি জঙ্গিরা। আবার পুলিশের নজরদারির কারণে সেভাবে তারা সংগঠন গোছাতেও ব্যর্থ হচ্ছে। চলতি বছরই সিটিটিসি ৪৭ উগ্রপন্থিকে গ্রেপ্তার করেছে।
সিটিটিসির এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর বড় ধরনের হামলার সক্ষমতা নেই। আর হুজিবি এখন মৃতপ্রায়। সাইবার ওয়ার্ল্ডে যাতে জঙ্গিরা সক্রিয় হতে না পারে, সে ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে।
পুলিশ-র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনেক দিন ধরেই জঙ্গিরা বোমা তৈরির সরঞ্জাম সহজে হাতে পাচ্ছে না। এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতায় দিশাহারা তারা। মাঝেমধ্যে তারা অনলাইনে সদস্য রিক্রুট করার চেষ্টা চালায়। অনলাইনে অনেকে নেতাও সাজে। তবে সাইবার লিডারশিপকে সাধারণত সেভাবে মান্য করে না সংগঠনের সদস্যরা। কেউ কাউকে আস্থায় নিতে পারে না।
ঘরে বসে বিভিন্ন সংগঠনের যেসব জঙ্গি অনলাইনে সক্রিয়, তারা নিজেদের ভাষা ‘কি-বোর্ড জিহাদী’ ও ‘কাঁথা জিহাদি’। যার অর্থ হলো, কাঁথার নিচে শুয়ে কম্পিউটার বা ল্যাপটপের কি-বোর্ড টিপে আদর্শ প্রচারে নিয়োজিত থাকা। যাদের বড় ধরনের হুমকি মনে করাও হয় না।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ছাড়াও দেশে অন্তত ১৩টি হামলায় হুজিবির জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। এতে ১০১ জন নিহত ও সাত শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ২০১৭ সালে হুজিবির দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ তার দুই সহযোগীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সংগঠনটি এখন কার্যত নেতৃত্বশূন্য ও দুর্বল। ওই বছর টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করে হুজিবির জঙ্গিরা। তখন তারা যে বোমা ব্যবহার করেছিল, তা দেখে গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, শক্তিশালী কোনো বোমা তৈরির রসদও হুজিবির নেই।
তবে সক্রিয় না থাকলেও হুজিবি গত এক বছরে দেশে ১০টির মতো ছোট ছোট বোমা হামলা করেছে। যার মধ্যে আটটি হামলার টার্গেট ছিল পুলিশ। পুলিশের সর্বশেষ তথ্যমতে, নব্য জেএমবির একটি গ্রুপ গত ২৩ জুলাই সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে হামলার ছক করেছিল। কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে তা ব্যর্থ হয়। এতে জড়িত পাঁচ জঙ্গিকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪ জুলাই ঢাকার পল্টনে পুলিশের চেকপোস্টের অদূরে বোমা হামলা চালানো হয়। ৩১ জুলাই নওগাঁ জেলার সাপাহার এলাকায় মন্দিরে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট মোড়ের পুলিশ বক্সে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নগর ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আরাফাতুর রহমান, সহকারী পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) মো. আতিকসহ পাঁচজন আহত হন। বিস্ফোরণের পরদিন হামলার দায় স্বীকার করে কথিত বার্তা দেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ওই হামলায় জড়িত তিনজন নব্য জেএমবি সদস্যকে গত মে মাসে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নগরীর বাকলিয়া থানার ডিসি রোডের গণি কলোনিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
চট্টগ্রামে যে কৌশলে পুলিশ বক্সে হামলা করা হয়েছিল, একই ধরনের হামলা এর আগে ঢাকায়ও চালায় জঙ্গিরা। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পুলিশ বক্সের সামনে, ২৪ জুলাই খামারবাড়ি ও পল্টনে, ২৬ মে মালিবাগে এবং ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে একটি ট্রাফিক বক্সের পাশে বোমা হামলা চালায় তারা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলার পর ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জেএমবির জঙ্গিরাও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে হুজির জন্ম। মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে লড়তে বাংলাদেশে সংগঠনটি হুজিবি নামে যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৯ সালে যশোরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকীর হাত ধরে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটির ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া হয়। যাত্রা শুরুর পর থেকে এ জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন আবদুর রহমান ফারুকী, মঞ্জুর হাসান, মুফতি আবদুল হাই, কমান্ডার মঞ্জুর আহম্মদ, মুফতি আবদুস সালাম, মাওলানা মঞ্জুর হাসান, কমান্ডার বাসেদ, মুফতি শহীদুল ইসলাম এবং মুফতি হান্নান। বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১৩টি জঙ্গি হামলা চালায় হুজিবি। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা চালানোর পরের বছর ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা থেকে মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাকে টানা চার মাস রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করে জড়িত অন্যদের নামও জানায় সে।
হুজিবির প্রথম বোমা হামলা ছিল ১৯৯৯ সালে; যশোরে উদীচী অনুষ্ঠানে। খুলনায় আহমদিয়া মসজিদ, সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে হত্যাচেষ্টা, সিপিবির সমাবেশ, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজনকে হত্যা, কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা, রমনার বটমূলে হামলাসহ অন্তত ১৩টি হামলায় জড়িত হুজিবি। বিদেশে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা হুজিবির অনেক মুজাহিদ এরই মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে।