স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামী জুলাই থেকে যোগ দেওয়া চাকুরেদের সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা বিদ্যমান পেনশনের বদলে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে প্রয়োজনে তারা আন্দোলনে যাবেন।
এ ব্যাপারে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যেই কাজ করছে সরকার। সার্বিকভাবে বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন বলে আশা করছি।
অর্থ মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে আগামী ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকার পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করল। একই দিন সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ১ জুলাইয়ের পর থেকে ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি বাধ্যতামূলক। বিদ্যমান প্রগতি, প্রবাস, সুরক্ষা ও সমতা– এই চার পেনশন কর্মসূচি ঐচ্ছিক হলেও নতুন স্কিম বাধ্যতামূলক।
‘প্রত্যয়’ স্কিমে চাঁদার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা– এ দুয়ের মধ্যে যেটি কম, সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা চাকরিজীবীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংস্থা দেবে। দুই অঙ্ক একত্রে চাকরিজীবীর পেনশন আইডির (পরিচয় নম্বর) বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা করবে। যেদিন প্রতি মাসের বেতন দেওয়া হয়, তার পরের কর্মদিবসের মধ্যেই কাজটি করতে হবে। এ জমা অর্থের পরিমাণ ও মেয়াদের ভিত্তিতে অবসরকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন ভোগ করবেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে। যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে, সেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। আর স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে, যারা কোনো আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা। এর মধ্যে কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি রয়েছে।
এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জীবন বীমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ইত্যাদি রয়েছে এ তালিকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ১৪ লাখের বেশি।
নতুন এ সিদ্ধান্তে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষুব্ধ হলেও চাকরির ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হয়েছেন সরব। বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার এসআরওর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা বলছেন, এ প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হবেন। একই বেতন স্কেলের আওতাধীন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সরকারের ভিন্ন নীতি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তারা প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আন্দোলনে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো এরই মধ্যে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিবৃতিতে দিয়েছে।
জানা গেছে, বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের পর শুক্রবার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন জরুরি সভায় বসে। সেখানে তারা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের বিশ্লেষণ করে। পরদিন শনিবার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয়। ফেডারেশন সূত্র জানায়, আগামীকাল বুধবার সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর সমন্বয়ে অনলাইনে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এক সভার আয়োজন করা হয়েছে। সেখান থেকে ফেডারেশনের পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।
কেন আপনারা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন– এ প্রশ্নে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের সম্মান করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে গেছেন। সেই শিক্ষকদের প্রদেয় সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে আর তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, এটিই আমাদের জন্য লজ্জার। ৩০ জুনের পর আমাদের যে নতুন সহকর্মীরা আসবেন তারা জানবেন তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আর আসবে কি?
ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমরা আমাদের জন্য কিছু করছি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য, মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় ধরে রাখার জন্য কাজ করছি। তিনি বলেন, যে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। মেধাবীরা এ পেশায় আসবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহেদ রানা বলেন, হঠাৎ করে এমন প্রজ্ঞাপনের ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের দপ্তর সম্পাদক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে আগে সব শিক্ষক সমিতির মতামত নেওয়া হবে। এ জন্যই সভা ডাকা হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন সম্পূর্ণ স্থিতিশীল। পেনশনের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা বলে আমরা মনে করছি। অবিলম্বে আমরা এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতে গত আগস্টে চালু হয় সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। তখন চার শ্রেণির মানুষের জন্য চারটি স্কিম চালু হয়। সে সময় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেওয়া সুবিধামতো সময়ে সরকার আরও দুটি স্কিম চালু করে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কর্মসূচির আওতায় আনবে। সে ধারাবাহিকতায় এ সিদ্ধান্ত এসেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বিষয়ে সংস্কার আনা মানেই কিছু অংশ লাভবান হবেন, আবার কেউ কেউ কিছুটা হলেও ক্ষতির মুখে পড়বেন। তবে সরকার এসব ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক যেন লাভবান হয়, সেদিকে নজর দিয়ে থাকে। নতুন এ ব্যবস্থায় অল্প কিছু সংখ্যক সুবিধা হয়তো কমবে, কিন্তু এর বিপরীতে বড় একটি অংশ বাড়তি লাভবান হবেন। তাছাড়া নতুন বিধান বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এমনকি আগামী জুলাইয়ের আগে কেউ যোগ দিলে, তারাও এখনকার নিয়মে পেনশন পাবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন সিদ্ধান্তে আসার আগে এ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান পেনশন সুবিধা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কমিশন ও করপোরেশনে সরকারি কর্মচারীদের আদলেই পেনশন দেওয়া হয়, যা এ ধরনের মোট প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশের বেশি নয়। এর বাইরে প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলের (সিপিএফ) মাধ্যমে অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। এ তহবিলে চাকরিজীবীরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দেন, আর সংস্থা দেয় ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অবসরের পর এ টাকা এবং এর বাইরে প্রতিবছর দুই মাসের মূল বেতনের সমান আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) পান তারা। আবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলও নেই। এ ক্ষেত্রে অবসরের পর চাকরিজীবীরা শুধু গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকে। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।