সংক্রমণ ও মৃত্যু জ্যামিতিক হারে বাড়ছে
লেজেগোবরে অবস্থা জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে
১ জুন দেশে করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৫৩৪ জন। মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৬৭২ জন। এক মাস ১৭ দিনের মাথায় শুক্রবার করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৫৭ জনে পৌঁছেছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪৭ জনে।
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। গতকাল ছিল সংক্রমণের ১৩২তম দিন। এ হিসাবে প্রথম ৮৫ দিনে যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তার পরের ৪৭ দিনে আরও এক লাখ ৪৯ হাজার ৮২৩ জন আক্রান্ত এবং এক হাজার ৮৭৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। মোট আক্রান্তের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় এক লাখ ৪ হাজার ৯৫ জন। অর্থাৎ আক্রান্তের ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ ঢাকার বাসিন্দা। আর সারাদেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৫ হাজার ২৬২ জন। অর্থাৎ সারাদেশে আক্রান্তের হার ৪৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সংক্রমণ ও মৃত্যু জ্যামিতিক হারে বাড়লেও জোনভিত্তিক কার্যক্রমের খবর নেই। হাতেগোনা কয়েকটি এলাকায় এই ‘লকডাউন’ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
নানাবিধ সংকটের কারণে জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরে এসেছে বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্রটি জানায়, জেলা-উপজেলা নিয়েও নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানীর বিষয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ছোট ছোট এলাকা ধরে লকডাউনের কথা ভাবা হচ্ছে। সেটি সম্ভব না হলে করোনা পজিটিভ শনাক্ত ব্যক্তির বাসস্থান বা বাড়ি লকডাউনের কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এ কাজটি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কিনা কিংবা কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা হবে, সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। বিষয়টি জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্যরাও এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এমনকি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। এতে করে মোট সংক্রমিতদের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ সংক্রমিত রাজধানী ঢাকায় জোনভিত্তিক কার্যক্রম নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও জোনিংবিষয়ক কেন্দ্রীয় কারিগরি কমিটির সদস্য সচিব ডা. জহিরুল করিম বলেন, জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরুর জন্য নতুন করে জেলা ও উপজেলাভিত্তিক একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। আজ সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে। তবে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারীর বাইরে নতুন কোনো এলাকার কথা এখনও ভাবা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রাজধানীতে জোনভিত্তিক কার্যক্রমের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখছে বলে জানান তিনি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আগে থেকেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে কাজের সমন্বয় ছিল না।
এর মধ্যে জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করেই সময় পার করছেন। এতে করে লকডাউনসহ করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের বিভিন্ন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সবকিছুতেই একটা ঢিলেঢালা ভাব তৈরি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে ডিজি ডা. আবুল কালাম আজাদ বরখাস্ত হচ্ছেন। একই সঙ্গে বদলির জন্য আরও দেড় ডজন কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুত করার খবরও ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। পুরো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরজুড়ে এখন বদলি আতঙ্ক চলছে। কাকে কোন সময় বদলি করা হয়, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। এ অবস্থায় পুরো করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ নিয়েই চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
রাজাবাজারের অভিজ্ঞতা ভালো নয়, ওয়ারীও একই পথে :রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে গত ১০ জুন পরীক্ষামূলক লকডাউন শুরু হয়। শেষ দিন ৩০ জুন ১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১১ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ফলে লকডাউনের শেষ দিকে সংক্রমণ হ্রাস পাওয়া কথা। কিন্তু এ এলাকায় তা লক্ষ্য করা যায়নি। এরপর গত ৪ জুলাই থেকে রাজধানীর ওয়ারীতে লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউন শুরুর আগে ওই এলাকায় ৪৭ জন শনাক্ত হয়েছিলেন। লকডাউন শুরুর পর গতকাল পর্যন্ত ওই এলাকায় ১৭০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৭০ জনের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে। ওয়ারী এলাকার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, লকডাউন দেওয়া এলাকায় দোকানপাট খোলা রয়েছে। মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে তেমন কড়াকড়ি নেই। এ পরিস্থিতিতে লকডাউনের কার্যকর ফল পাওয়া কঠিন।
তবে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, পূর্ব রাজাবাজারের অভিজ্ঞতা ভালো। শেষ দিকে সেখানে সংক্রমণ কমে এসেছে। শেষ দিনে ১৮ জনের পরীক্ষা করে ১১ জনের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। বাইরে থেকে ওই এলাকায় বসবাসকারীদের স্বজনরা এসে পরীক্ষা করান। তাদের মধ্যে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শেষ দিনে ওই এলাকায় বসবাসকারী মাত্র দু’জনের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
ঢাকার অন্যান্য রেড জোনে কবে নাগাদ কার্যক্রম শুরু হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। তার অবস্থান থেকে এটি বলা সম্ভব নয়। তবে জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করা গেলে সংক্রমণ দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হতো বলে মনে করেন তিনি।
নেপথ্যে সমন্বয়হীনতা :ঘোষণা দিয়েও কেন জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করা যায়নি- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীতে জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করতে না পারার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাজেকর্মে সমন্বয়হীনতাই দায়ী। জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরুর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে ১৩ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ১৩ জুন রাজধানীর ৪৫টি ও চট্টগ্রামের ১০টি এলাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর কিছু এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় রেড জোনে কার্যক্রম শুরু করা গেলেও রাজধানীর দুটি এলাকা ছাড়া অন্যান্য রেড জোনে কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। লকডাউন নিশ্চিত করতে শুরুতেই স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে সুনির্দিষ্ট জোনিং ম্যাপ চান ঢাকার দুই সিটি মেয়র। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই জোন ম্যাপিং কার্যক্রমটি এখনও সম্পন্ন করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৭টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মিরপুর একটি এলাকা। কিন্তু মিরপুরের সব এলাকায় সংক্রমণ সমান নয়। যে এলাকা, পাড়া বা মহল্লায় সংক্রমণ বেশি সেগুলো নির্ধারণ করে লকডাউন করতে হবে। পুরো মিরপুরকে তো লকডাউন করা যাবে না। পূর্ব রাজাবাজার রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়ার পর সেখানে লকডাউন দেওয়া হয়।
জোনিং-বিষয়ক কেন্দ্রীয় কারিগরি কমিটির এক সদস্য সমকালকে জানান, সুনির্দিষ্ট জোন ম্যাপিং করতে গিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন। কারণ নমুনা পরীক্ষার সময় সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা যে ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করেছেন বর্তমানে অনেককে সে ঠিকানার পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেকের মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের ঠিকানায় শুধু ঢাকা লেখা রয়েছে। এতে দ্রুততার সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে ম্যাপিং কার্যক্রম তৈরির কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি এটুআই ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে। এর পরও পুরো প্রক্রিয়াটিকে গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এ কারণে রাজধানীতে জোন ম্যাপিং করা সম্ভব হচ্ছে না।
সুফল আসবে না- মত বিশেষজ্ঞদের :করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগ তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুরু থেকেই কাজকর্মে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণে করোনা পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে। অর্ধেকেরও বেশি সংক্রমিত ঢাকা নিয়ে তাদের পরিকল্পনা নেই। এটি আত্মঘাতী ব্যাপার। সর্বোচ্চ সংক্রমিত এলাকা বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম সংক্রমিত এলাকায় লকডাউনে সুফল আসবে না।
বিএসএমএমইউর সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, করোনা যে গতিতে বিস্তার ঘটাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কালক্ষেপণ ও যথাযথভাবে তা প্রয়োগ করতে না পারার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। সার্বিক কার্যক্রম দেখলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না। থাকলে জোন ম্যাপিং করতে এতদিন লাগার কথা নয়। এটি তো মাত্র তিন ঘণ্টার কাজ।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়নি, এ কথা সঠিক নয়। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর কয়েকটি এলাকায় লকডাউন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। নতুন করে জেলা ও উপজেলায় ম্যাপিং চলছে। যখন যে এলাকায় ম্যাপিং সম্পন্ন হবে, তখন ওই এলাকায় লকডাউন বা জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হবে। এটি নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।