বিশ্বজয়ের ঘণ্টা চারেক পরও ফোনের ওপারে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। হৃদয়ের দুই কূলে তখন আছড়ে পড়ছে অন্য এক আবেগের ঢেউ। ব্যাট হাতে নতুন ইতিহাসের কারিগরকে নিয়ে সে আবেগ সামলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ফেলে আসা দিনেও ঢুঁ মারলেন বিশ্বজয়ী দলের ফিল্ডিং কোচ ফয়সাল হোসেন। একটু সময় নিয়ে পৌঁছালেন স্থির এক সিদ্ধান্তেও, ‘এত বড় ত্যাগ স্বীকার বাংলাদেশ ক্রিকেটে আর কেউ কখনো করেছে বলে আমার জানা নেই।’
খেলা ছাড়ার পর পুরোদস্তুর কোচ বনে যাওয়া জাতীয় দলের সাবেক ব্যাটসম্যান ফয়সাল যাঁর ত্যাগ স্বীকারের কথা বললেন, তিনি খোদ বিশ্বজয়ী অধিনায়ক আকবর আলী। বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার সময় পিঠাপিঠি বোন খাদিজা খাতুনকে রেখে গেছেন সন্তান জন্ম দেওয়ার রোমাঞ্চকর অপেক্ষায়। অথচ আগামীকাল বিকেলে ট্রফি নিয়ে দেশের মাটিতে নামার সময় আকবরদের চার ভাইয়ের সেই একমাত্র বোনটিই নেই। যমজ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে খাদিজার ওপারের ঠিকানায় পাড়ি জমানোর খবরও আকবর জেনেছিলেন দুই দিন পর। পরিবারের পক্ষ থেকে টিম ম্যানেজমেন্টকে অবশ্য সেই খবরটি না জানাতেই অনুরোধ করা হয়েছিল।
২২ জানুয়ারির ঘটনা টিম ম্যানেজমেন্ট জানায় ২৪ জানুয়ারি গ্রুপ পর্বের পাকিস্তান ম্যাচের পর। কান্নায় ভেঙে পড়া আকবর তবু শোকের জানুয়ারি পেছনে ফেলে ৯ ফেব্রুয়ারির পচেফস্ট্রুমে বিশ্বজয়ের নায়ক। যা তাঁকে বানিয়ে দিয়েছে প্রতি মুহূর্তে শোককে শক্তিতে পরিণত করা এক যোদ্ধাও। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার অভিজ্ঞতায় ফয়সালকে তাই বলতেই হয়, ‘বোন হারানোর ব্যথা বুকে নিয়েই বাকি টুর্নামেন্ট খেলেছে আকবর। এই একটি উদাহরণ থেকেই আপনারা বুঝে নিন, আমাদের খেলোয়াড়রা কত ত্যাগ স্বীকার করেছে। তামিম হয়তো আঙুল ভাঙা নিয়ে খেলেছে। অনেক প্রচারও পেয়েছে। কিন্তু একবার ভাবুন তো, কারো বোন মারা গেছে এবং সেই শোক নিয়েই পুরো টুর্নামেন্টে সে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপ জিতিয়েছে, ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছে। এ রকম কিছু আর কখনো ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ে না।’
মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার মতো সেই খবরটি ফয়সালই প্রথম দেন আকবরকে, ‘ওর পরিবার তো আমাদের জানাতেই নিষেধ করেছিল। আমরা খবরটি দুই দিন পর দিই। পাকিস্তান ম্যাচের পর। টিম ম্যানেজমেন্টের সবাই ওকে নিয়ে বসি। ওকে বলার দায়িত্বটি আমাকেই দেওয়া হয়।’ বলার পর যা হওয়ার কথা, হয়েছিলও তা-ই, ‘প্রথম শোনার পরে অনেক কান্নাকাটি করেছে। ওর মাকে নিয়েও খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল।’ যেটি নিয়ে বিশ্বকাপ জেতার পরও কথা বলতে আগ্রহী হলেন না ফাইনালে অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংসে নতুন ইতিহাস লেখা আকবর। গতকাল পচেফস্ট্রুম থেকে জোহানেসবার্গের হোটেলে চেক ইন করার সময় ফোনে ধরা হলে বললেন, ‘প্লিজ, এটি নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
অথচ রুমের চাবি বুঝে নেওয়ার তাড়ার মধ্যেও দলের সাফল্য নিয়ে কথা বলতে তাঁর দ্বিধা ছিল না একটুও। শোক সামলে যাঁকে দ্রুতই ক্রিকেটে মনোযোগী হতে দেখেছেন ফয়সাল, ‘প্রথমে কান্নাকাটি করলেও আমরা পরে দেখলাম, অনুশীলন থেকে শুরু করে সব কিছুই ঠিকঠাক করছে।’ যা দেখে কোচিং স্টাফের সদস্যরা বিস্মিতই হয়েছেন শুধু, ‘আপনাদের বুঝতে হবে এটি অনূর্ধ্ব-১৯ দল, জাতীয় দল নয়। জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা না হয় খেলতে খেলতে মানসিকভাবে অনেক পরিণত হয়ে যায়। শিখে যায় অনেক কিছু সামলে নিতেও। আর এরা মাত্র কিছুদিন হলো খেলছে। এর মধ্যে এ রকম ঘটনা ঘটলে এই বয়সের কেউ সামলাতে পারবে বলে আমাদের ধারণাতেই ছিল না। আমরা অবাক হয়ে গেছি এতটুকু একটি ছেলে মানসিকভাবে এত শক্ত হয় কী করে?’
ব্যক্তিগত শোকের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা আকবর নিজের অন্তর্গত শক্তিও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পুরো দলেই। সে জন্যই বিশ্বজয়ের সাফল্যে এই শোকের মহিমাও আছে বলে মনে করেন ফয়সাল, ‘এটি একটি ঘটনা। যা আমাদের দলকে আরো ঐক্যবদ্ধ করেছে। আরো অনেক ঘটনা আছে এই ৪০ দিনে। বলে শেষ করা যাবে না। ইনজুরি, এটা-ওটা তো ছিলই। ইনজুরি নিয়েও খেলেছে ছেলেরা। দুই-তিনটা এমন ইনজুরি ছিল, আমরা খুবই চিন্তায় ছিলাম। ওরা যেটা করেছে, নিজ চোখে না দেখলে আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। বিশেষ করে আকবরের শোক সামলে ওঠার ঘটনা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ছেলেদের আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করতেও অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্যদের সামনে উদাহরণই হয়ে উঠেছিল সে।’