The news is by your side.

লোহিত সাগরে হুতি হামলায় গোটা বিশ্ব বিপদে

0 121

 

গাজায় ইসরায়েলি হামলা ত্রয়োদশ সপ্তাহে পা দিয়েছে; এর ধ্বংসাত্মক প্রভাবও বিশ্বজুড়ে অনুভূত হচ্ছে। বিশেষত গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের প্রাণ হারানোর প্রভাব গোটা আরব অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়েছে। অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধও শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা হচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রধান প্রধান শহরে গণবিক্ষোভ হচ্ছে। আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে এবং হুতিরা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

ইয়েমেনভিত্তিক হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলগামী এবং বাবেল মান্দেব প্রণালি দিয়ে চলমান জাহাজকে নিশানা করে যে আক্রমণ শুরু করেছে, তারা ব্যাপক সংকটের জন্ম দিয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইসরায়েলগামী কার্গো জাহাজ ‘গ্যালাক্সি লিডার’ দখল করে নিয়ে যায়। জাপান পরিচালিত ব্রিটিশ মালিকানাধীন এই জাহাজ পরে ইয়েমেনি বন্দর হোদেইদাহের দিকে নিয়ে এর ক্রুদের জিম্মি করা হয়। এই হামলার পর থেকে কেবল লোহিত সাগরেই হুতিরা ৪০টির বেশি জাহাজকে নিশানা করেছে।

আগে মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তিন মাসের গাজা যুদ্ধ এখন অর্থনৈতিক সংযোগ এবং বৈশ্বিক সামুদ্রিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে প্রভাবিত করছে। বাবেল মান্দেব প্রণালি দিয়ে বৈশ্বিক কনটেইনারের ৩০ শতাংশ চলাচল করে। এটি বৈশ্বিক নৌ যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, অন্য দুটি হলো মালাক্কা প্রণালি ও পানামা খাল।

হুতি বিদ্রোহীরা যে কৌশল ব্যবহার করছে, তা নতুন নয়। আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ট্যাঙ্কার যুদ্ধের কথা আমরা জানি। ওই সময় উভয় রাষ্ট্র হরমুজ প্রণালি দিয়ে চলাচলকারী শত্রু দেশ ও তার মিত্রদের ট্যাঙ্কারগুলোকে নিশানা করত। বর্তমান হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সরকার অর্থায়ন করছে বলে মনে করা হয় এবং বর্তমান কৌশলের লক্ষ্য হলো, চলমান সংঘাত বন্ধে পশ্চিমাদের চাপ সৃষ্টি করা।

বাবেল মান্দেব প্রণালিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল ধমনী’ আখ্যা দেওয়া হয়। এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্যিক জাহাজগুলোয় বাধা দেওয়ার অর্থ হলো, বিশ্বব্যাপী তেল এবং পণ্যের দামে সরাসরি প্রভাব ফেলা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লোহিত সাগর সংকট শুরুর পর থেকে ‘ব্রেন্ট ক্রুড’ তথা তেলের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ৮ শতাংশ বেড়েছে। আশির দশকে ট্যাঙ্কার যুদ্ধের সময় ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলার অতিক্রম করেছিল, যা আজকের ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলারের সমান। প্রধান শিপিং কোম্পানিগুলো জাহাজকে দক্ষিণ আফ্রিকার পাশ দিয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে। সেটা দীর্ঘ এবং তাই আরও ব্যয়বহুল পথ।

৭ অক্টোবরের হামলার পরই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করেছিল; এখন টহল ও তদারকি বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও বাহরাইনও এই এলাকায় জাহাজ পাঠিয়েছে। কিন্তু শিপিং কোম্পানিগুলো এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে। এভারগ্রিন লাইন কোম্পানি ‘পরবর্তী নোটিশ পর্যন্ত’ লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে। লোহিত সাগরে হুতিদের ঘন ঘন আক্রমণের ফলে ইন্স্যুরেন্স ফি বেড়েছে এবং শিপিং কোম্পানিগুলো ভাড়ার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে ইউরোপ ও আফ্রিকাগামী ভারতীয় কার্গোর মূল্যও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, এই বৃদ্ধি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে।

প্রশ্নটি কেবল অর্থের নয়; নিরাপত্তারও। কয়েক দিন আগে ভারতের ম্যাঙ্গালুরগামী এমভি কেম প্লুটো লোহিত সাগর অতিক্রমকালে হুতি হামলার শিকার হয়েছিল। তখন ওই অঞ্চলে টহলরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজের সাহায্য চাইলে তারা এগিয়ে আসে। ২৪ ডিসেম্বর ভারত পরিচালিত আরও দুটি জাহাজ এমভি সাইবাবা ও ব্লামেনেনও ড্রোন হামলার শিকার হয়। এসব ঘটনার পর ভারতীয় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড ওই অঞ্চলে নিরাপদ জাহাজ চলাচল নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আইএনএস বিশাখাপত্তমসহ অন্তত পাঁচটি ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী জাহাজ সেখানে টহল দিচ্ছে।

অবশ্য লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী ভারতীয় তেল সরবরাহকারী জাহাজে আক্রমণ হয়নি। এর রহস্য হলো রাশিয়ার সম্পৃক্ততা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থনকারী ইরান হলো রাশিয়ার অংশীদার ও মিত্র। ইরান-রাশিয়া সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, বিশেষ করে ইরানের শহীদ ড্রোন রাশিয়ার অস্ত্রাগার সমৃদ্ধ করেছে।

এই ঘনিষ্ঠতার কারণে হুতিরা রাশিয়ার বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা থেকে বিরত রয়েছে। তবে এই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অন্য দেশগামী যেমন– পশ্চিম ইউরোপের দিকে রওনা হওয়া ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ ততটা নিরাপদ নাও হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকে ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখে আরব বিশ্ব। যে কারণে গাজায় চলমান যুদ্ধে এসব দেশও ইসরায়েলের সমর্থক। ভারত-ইরানের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকায় হুতি আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে দিল্লির অনুরোধ তেহরান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে বলে আশা করা যায়।

যা হোক, বাবেল মান্দেব প্রণালি ও লোহিত সাগরে হুতি হামলার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক রুটগুলোর সার্বিক নাজুকতাও স্পষ্ট হচ্ছে। আর হামলাগুলো দিন শেষে সামগ্রিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে এবং বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে।

বহু মেরুর বিশ্বে একাধিক রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির উত্থানের মানে হলো, অন্যান্য আরও শক্তি অর্থনৈতিক বাণিজ্য প্রবাহে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের মতো দেশগুলো, যাদের বহুপক্ষীয় পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে, তাদের উচিত হবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা। তা শুধু নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নয়; বাণিজ্য ও পরিবহন সুরক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.