ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম অনেক রাজ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে থেকেছে অনেকদিন থেকেই। কিন্তু বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল যে পশ্চিমবঙ্গে, সে রাজ্যে রাজনীতিতে তা ছিল বিরল।
ধর্মের প্রসঙ্গ খুব একটা কোনও দলই নিয়ে আসত না রাজনীতিতে। কিন্তু এবছরই সে রাজ্যের ভোটে কোনও না কোনও ভাবে ধর্ম বেশ প্রকটভাবে উঠে আসছে প্রচারে।
কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মের উত্থান হল, সেই খোঁজ করতে গিয়ে ১৩ ই এপ্রিল রামনবমীর দিন সকালে দেখছিলাম কলকাতার নানা জায়গায় বিজেপি প্রার্থীরা মিছিলে হাঁটছেন।
দলের হয়ে ভোট প্রচারে দুবেলাই তারা বেরচ্ছেন। কিন্তু ওইদিনের মিছিলগুলোয় না ছিল কোনও দলীয় পতাকা, না উঠছিল বিজেপির প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার স্লোগান।
শুধুই ছিল জয় শ্রীরাম ধ্বনি।
এই রামনবমীকে কেন্দ্র করেই গতবছর বেশ কয়েকটি জায়গায় দাঙ্গা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।
শুধু যে রামনবমী পালন, তা নয়। পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং হনুমান জয়ন্তী থেকে শুরু করে সব ধর্মের নানা অনুষ্ঠানেই দেখা যায় রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের।
বছরের অন্যান্য সময়ে সেই সব ধর্মের অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক উপস্থিতি চোখে পড়ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু এবার নির্বাচনী প্রচারে যেভাবে ধর্ম আর ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান জায়গা করে নিয়েছে, তা আগে দেখা যায় নি।
“এটা একেবারে নতুন সংযোজন পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে। প্রত্যক্ষ আর আগ্রাসী ধর্মীয় রাজনীতি আগে কখনও দেখি নি। এটার মূল কিন্তু ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতিতে লুকিয়ে আছে। মুসলমানরা একটা ভোট ব্যাঙ্ক, আবার হিন্দুরা আরেকটা ভোট ব্যাঙ্ক,” বলছিলেন কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক শিখা মুখার্জি।
“দুর্গাপুজোও যেমন ধর্ম, ঈদও তেমনই ধর্ম। দুটোই থেকেছে পাশাপাশি চিরকাল। কিন্তু সেটাকে রাজনীতির প্রচারে নিয়ে আসা, ওতপ্রোতভাবে রাজনীতিতে জুড়ে দেওয়া, এটা একটু একটু করে শুরু হয়েছে ২০১৪ থেকেই। ২০১৬র বিধানসভা নির্বাচনেও সেই চেষ্টা হয়েছে, গতবছর পঞ্চায়েত ভোটেও হয়েছে। আর এবারে তো একেবারে সরাসরি নিয়ে আসা হচ্ছে ধর্মকে।”
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রচারক মমতা ব্যানার্জী নিজেই। তিনি প্রতিটি নির্বাচনী জনসভাতেই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কড়া সমালোচনা করছেন তার নিজস্ব বক্তৃতার স্টাইলে।
কিন্তু তার সেই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের বিষয়টাকে উস্কিয়ে দিতে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছে যে এটা তৃণমূল কংগ্রেসের, তাদের ভাষায়, সংখ্যালঘু তোষণ।
অধ্যাপক মীরাতুন নাহার অবশ্য বলছিলেন, “ব্রিটিশ শাসকরা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে যে চারা রোপণ করেছিল, তাকেই জল, সার দিয়ে রাজনীতিকরা বড় করে এখন একটা মহীরুহের রূপ দিয়েছেন। আজকের যে পরিস্থিতি, সেটা একদিনে হয় নি। ওই দেশভাগ বা তার ঠিক আগে থেকে বিদেশী শাসকরা তাদের স্বার্থে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এই বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু জাতি হিসাবে আমরা এতটাই হতভাগ্য যে এত বছরেও তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম না। ”
যে পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল – যারা নিজেরা ধর্মাচরণ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন এবং ধর্মের বিষয়টা সেভাবে নিয়ে আসেন নি রাজনীতিতে, সেই রকম একটা রাজ্যের রাজনীতিতে ধর্ম কীভাবে ঢুকে পড়ল?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশিষ বিশ্বাসের কথায়, “কংগ্রেস বা বাম আমলে কখনও দেখি নি কোনও কোনও ধর্মের অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমক করে পালন করা হচ্ছে। এর ক্ষেত্রটা হয়তো আগে থেকেই ছিল। মুসলমানদের কোনও অগ্রগতি বা উন্নতিতে চিরকালই কিছুটা বিচলিত হতেন হিন্দুদের একটা অংশ। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে ইমাম ভাতা, মুয়াজ্জিন ভাতা প্রভৃতি চালুও করার পর থেকেই হিন্দুদের মধ্যে বিচলিত হয়ে ওঠার সংখ্যাটা বাড়তে আরম্ভ করল।”
“হিন্দু আর মুসলমান দুই পক্ষেই কিছু মানুষ আছেন, যারা মনে করেন যে তারাই শোষিত, নিপীড়িত। দুই পক্ষই মনে করে যে অন্য পক্ষটি অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উন্নত হতে চাইছে। এই ভ্রান্ত ধারণার প্রচারও কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট রয়েছে,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতা তৃণমূল কংগ্রেস বা বামপন্থীরা আর কংগ্রেস – সকলেই করছে। কিন্তু মূল বিরোধিতা করছেন যিনি, তিনি তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী।
তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলছিলেন যে তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে বিজেপির ধর্মীয় কার্ডের মোকাবিলা করছে, সেটা কতটা কার্যকরী হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছে।
“যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে অনেকরকম প্রশ্ন উঠতে পারে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে যে দল, তার নীতি, তার মতাদর্শের বিরোধিতা যখন করতে গেছে এখানকার ক্ষমতাসীন দল, তখন তারা আবার সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বোঝাপড়াটা বাড়িয়েছে। সেটা ভোটের অঙ্ক মেলানোর জন্যই হয়তো করা হয়েছে। কিন্তু তাতে বিজেপিকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক,” বলছিলেন মি. বসু রায়চৌধুরী।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যে, বিশেষত উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে ধর্মীয় বিভাজন, জাতপাতের রাজনীতি দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ধর্মের রাজনীতি নতুন।
ভোটের ফলাফলেই বোঝা যাবে যে ধর্মের রাজনীতি কতটা শক্ত ভিত গাড়তে পেরেছে এই রাজ্যে।