পারুলকার, হাতিরাম চৌধুরীদের সারিতে জায়গা পেতে পারে কলকাতার সুরঞ্জন সেনও। সায়ন্তন ঘোষালের সিরিজ় ‘লালবাজার’-এ সেই চেষ্টা রয়েছে। কলকাতার ক্রাইম ব্রাঞ্চের গল্প শহরের চেনা ভাষাতেই বলা হয়েছে। কারও অনুকরণ করা হয়নি। পরিবেশনে অভিযোগ থাকলেও, শেষ অবধি গল্পটি তার গন্তব্যে পৌঁছয়। ইঙ্গিত থাকে দ্বিতীয় সিজ়নেরও।
যৌনপল্লি, মাফিয়ারাজ, খুন… পারফেক্ট ক্রাইম সিন। সিরিজ়ের প্রথম পর্ব থ্রিলারের মুড তৈরি করে দেয়। এই একটি খুনের উল্লেখ বাকি ন’টি পর্বেই ঘুরেফিরে আসতে থাকে। বাকি পর্বগুলি জুড়ে রয়েছে শহরের রোমহর্ষক কয়েকটি অপরাধ এবং লালবাজারের দুঁদে অফিসারেরা কী ভাবে অপরাধীকে পাকড়াও করছে। মূল প্লটের সঙ্গে এই অপরাধগুলির তেমন যোগ নেই। সিরিজ়ের ক্ষেত্রে এটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট, দুর্বল জায়গাও বটে। কারণ সাব-প্লটগুলি যদি মূল প্লটে কিছু যোগ না করে, তবে ধৈর্যচ্যুতি ঘটা স্বাভাবিক।
লালবাজারের এসি (হোমিসাইড শাখা) সুরঞ্জন সেন (কৌশিক সেন)। তার টিমে রয়েছে মীরা (সৌরসেনী মৈত্র), গৌরাঙ্গ বিশ্বাস (অনির্বাণ চক্রবর্তী), আনিসুর (বিজয় সিংহ)। সুরঞ্জনের কেরিয়ারে গোড়ার দিকের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং ওয়াটগঞ্জ থানা। সেখানকার ওসি সাবির আহমেদ (গৌরব চক্রবর্তী), পোর্ট এলাকার এসি গৌরব দত্ত (সুব্রত দত্ত)। লালবাজারের সদস্যদের মতোই শেষ পর্যন্ত নজর কাড়ে ফরজ়ানা (রঞ্জিনী চক্রবর্তী)। সুরঞ্জনের লিভ-ইন-পার্টনার মায়া (হৃষিতা ভট্ট), সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি।
সিরিজ়ের অপরাধগুলিতে শহরের সাড়া জাগানো কয়েকটি ঘটনার ছায়া রয়েছে। যেমন, রবিনসন স্ট্রিটের ছায়ায় দেখানো একটি ঘটনায় মায়ের মৃতদেহ নিয়ে বাস করে তার মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলে। রিজ়ওয়ানুর রহমানের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয় আনিসুরের বোনের নির্মম পরিণতির খাতিরে। হিন্দু ছেলের সঙ্গে প্রেম করার দায়ে সে হুইলচেয়ারবন্দি। এ ছাড়া নাবালিকার ধর্ষণ, হোমের নামে নাবালিকাদের দিয়ে ব্যবসা করানো, নাবালক হত্যাকারী… স্পর্শকাতর দৃষ্টান্তগুলি ফুটে উঠেছে। দেখানো হয়েছে হোমোফোবিক খুনিকেও। অর্থাৎ শহরের অপরাধজগৎ যত ভাবে এক্সপ্লোর করা যায়, আর কী!
সুরঞ্জনের চরিত্রে কৌশিক সেনের শরীরী ভাষা অনবদ্য। পুলিশের চরিত্রে গৌরব চক্রবর্তীকে আগেও দেখা গিয়েছে। তবে এই সিরিজ়ের অন্যতম বলিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তিনি নজর কেড়েছেন। ডন আব্বাস গাজ়ির চরিত্রে দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য পারফেক্ট কাস্টিং। ‘তুম্বড়’ছবি খ্যাত রঞ্জিনীও যথাযথ। পুলিশের চরিত্রে ভাল সৌরসেনীও। তবে অভিনয় নয়, সিরিজ়ের সমস্যা অন্যত্র।
এই সিরিজ়কে মেদহীন করার দরকার ছিল, সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু পরিচালক সে সুযোগ কাজে লাগাননি। প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্য কম করা যেত। কতকগুলি অতিরিক্ত দৃশ্য রয়েছে, যা এই ধরনের সিরিজ়ে বেমানান। যেমন, গৌরাঙ্গ ও তার স্ত্রীর চটুল বার্তালাপ। বাংলা ওয়েব সিরিজ়ের সুড়সুড়ি দেওয়া আরোপিত সংলাপ অসহনীয়! লালবাজারের টিমে থেকেও গৌরাঙ্গ যখন প্রশ্ন করে, ‘অ্যাসফিক্সিয়া’ (শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু) কী, সিরিজ়ের মান এক ঝটকায় পড়ে যায়। সাব-ইন্সপেক্টর মীরা যে ভাবে হোম থেকে নাবালিকাদের উদ্ধার করে, তা-ও অবাস্তব, অবিশ্বাস্য। লালবাজারের মান বজায় রাখতে হবে বলেই কি এত সহজে অপরাধীদের ধরে ফেলতে হয়? মায়ার প্লটটিও ঠিক স্পষ্ট হল না।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুলিশ অফিসার এখনকার সব থ্রিলারের একটি বাঁধা গতের চরিত্র। এই সিরিজ়ের প্রেক্ষাপটে এমন চরিত্রদের সামনে আনার জন্য পরিচালককে ধন্যবাদ। তবে যে কলকাতা দৌড়তে পারত, তাকে শুধু নড়নচড়নেই আটকে দিল ‘লালবাজার’-এর কিছু অপ্রয়োজনীয় উপাদান।