ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ছ’মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত এলাকা দখল করে নিয়েছে। তবে সম্প্রতি ইউক্রেন সেসব অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গা পুনর্দখল করেছে।
বলা হচ্ছে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে রুশ সৈন্যরা পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান শহরগুলো থেকে পিছু হটে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে সেপ্টেম্বরের শুরুতে পাল্টা আক্রমণ শুরু করার পর রাশিয়ার কাছ থেকে ৩,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা মুক্ত করেছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দৃশ্যত ইউক্রেনের অগ্রাভিযানে গতি সঞ্চার হয়েছে এবং এসবই সম্ভব হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে কিয়েভকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি দেওয়ার কারণে।
ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর এই সামরিক সহায়তা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বৃহত্তম এই যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে।
সরাসরি সামরিক সাহায্য দেওয়ার বিচারে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অগাস্ট মাস পর্যন্ত পাওয়া এই হিসেবে দেখা যাচ্ছে ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুত এই সাহায্যের পরিমাণ অন্য যেকোনো দেশের চাইতে কয়েক গুণ বেশি।
তার পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউক্রেনের প্রতিবেশি দেশ পোল্যান্ড। ব্রিটেনের অবস্থান তৃতীয়।
জার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিল ইন্সটিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির এক পরিসংখ্যানের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ যেসব অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তার আর্থিক হিসাব নিচে উল্লেখ করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্র: ৮৭৯ কোটি ডলার, পোল্যান্ড: ১৮৩ বিলিয়ন, ব্রিটেন: ১৩৬ কোটি, কানাডা: ৯৫ কোটি, জার্মানি: ৬৭ কোটি, চেক প্রজাতন্ত্র: ৩৫ কোটি. ডেনমার্ক: ২৭ কোটি, লাটভিয়া: ২৫ কোটি, এস্তোনিয়া: ২৫ কোটি এবং অস্ট্রেলিয়া: ২৪ কোটি ডলার
এর পরেও যুক্তরাষ্ট্র আরো কিছু সামরিক সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেছে। ২৪শে অগাস্ট ৩০০ কোটি ডলার, ৯ই সেপ্টেম্বরে আরো ৬৭.৫ কোটি ডলারের অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওয়াশিংটন। ফলে সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১২৫০ কোটি ডলার।
ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও অগাস্ট মাসে ইউক্রেনকে আরো প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি আরো সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ইউক্রেনের প্রতি মাসে ৫০০ কোটি ডলার খরচ হচ্ছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বেশ কয়েকটি অস্ত্র ইউক্রেন-রাশিয়ার এই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যার একটি হচ্ছে দীর্ঘ-পাল্লার রকেট।
যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত ইউক্রেনে অন্তত এক ডজন দীর্ঘ-পাল্লার রকেট লঞ্চার পাঠিয়েছে। ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশও কিয়েভে এই একই অস্ত্র পাঠাচ্ছে।
তবে ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য এধরনের রকেট তাদের আরো বেশি সংখ্যায় প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অস্ত্রটির নাম হাইমার্স রকেট লঞ্চার সিস্টেম বা হাই মবিলিটি আর্টিলারি রকেট।এই রকেট লঞ্চার থেকে একসঙ্গে কয়েকটি রকেট নিক্ষেপ করা যায়। স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত এই রকেট দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে আঘাত করা সম্ভব। আঘাত করতে পারে খুব দ্রুত।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র- এই তিনটি দেশ জুলাই মাসের শুরুর দিকে ইউক্রেনে শতাধিক এম৭৭৭ হাওইটজার্স লঞ্চার সরবরাহ করে।
এর সঙ্গে পাঠিয়েছে তিন লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ। এসবের আকার ১৫৫ মিলিমিটার।
পশ্চিমা দেশগুলোর দেওয়া এম৭৭৭ হাওইটজার লঞ্চারের পাল্লা রাশিয়ার গিয়াসিন-বি হাওইটজার পাল্লার সমান। তবে রুশ কামান ডি-৩০ হাওইটজারের পাল্লার চেয়ে অনেক বেশি।
কাঁধে বহন করে গোলা ছোঁড়া যায় এরকম হালকা ওজনের ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী অন্তত ৫,০০০ ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়া হয়েছে ইউক্রেনকে।
এন-ল নামের এই অস্ত্রটি থেকে একটি মাত্র ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেই শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব।
পোল্যান্ড এবং চেক প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনকে ওয়ারশ চুক্তি অনুসারে তৈরি ২৩০টি ট্যাঙ্ক সরবরাহ করেছে।
এর নাম টি-৭২ ট্যাঙ্ক। ওজন ৪৬ টন। গতি ঘণ্টায় ৩৭ মাইল। এটি আড়াই মাইল দূরের টার্গেটে হামলা করতে সক্ষম।
ইউক্রেনের এই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত প্রচুর ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
এসব ড্রোনের ব্যবহার মূলত নজরদারির জন্য। এর পাশাপাশি শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আক্রমণ করার লক্ষ্যেও ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
সম্প্রতি তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে বায়রাক্টার টিবি২ নামের একটি ড্রোন বিক্রি করেছে। এই ড্রোনটি অস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
বায়রাক্টার টিবি২ ড্রোন সর্বোচ্চ ২৫,০০০ ফুট উপরে পর্যন্ত উড়তে পারে। এর সর্বোচ্চ পাল্লা ১৮৬ মাইল। এবং সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৪০ মাইল।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে বায়রাক্টার টিবি২ ড্রোন অত্যন্ত কার্যকরী একটি অস্ত্র।
ধারণা করা হচ্ছে এই ড্রোনের সাহায্যে রাশিয়ার হেলিকপ্টার, নৌযান এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে।
এছাড়াও রুশ সৈন্যরা ঠিক কোথায় অবস্থান করছে তা জানার জন্যেও এই বায়রাক্টার টিবি২ ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইউক্রেন দাবি করছে যে রুশ যুদ্ধবিমানের হাত থেকে তারা তাদের নিজেদের আকাশসীমা রক্ষা করার ব্যাপারে সফল হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে অত্যাধুনিক এরকম একটি বিমান-প্রতিরোধী ব্যবস্থা পাঠিয়েছে যার নাম নাসামস। এটি ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের একটি সিস্টেম।
স্লোভাকিয়াও ইউক্রেনে এস-৩০০ বিমান-প্রতিরোধী ব্যবস্থা পাঠিয়েছে।