সারা বিশ্বের চোখ এখন গাজার দিকে। রাফাহ শহরে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইসরায়েল। হয় এই অভিযানে ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হবে ইসরায়েল, আর নয়তো পুরো আরব বিশ্ব জড়িয়ে পড়বে বড় এক সংঘর্ষে।
২৪ নভেম্বর হামাস এবং ইসরায়েলের মাঝে অস্থায়ী একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়। এর ওপর ভিত্তি করে স্থায়ী একটি যুদ্ধবিরতি এবং গাজায় শান্তি স্থাপনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সে সম্ভাবনা ধুলোয় মিটিয়ে দিয়েছে তেল আবিব।
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় যে অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল, এর প্রায় ছয় মাস পর দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল কোনোভাবেই হামাসকে উৎখাত করতে সক্ষম নয়। গাজা থেকে তো নয়ই, ফিলিস্তিন থেকেও নয়।
সম্প্রতি প্যারিস, কায়রো এবং দোহায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনায় স্পষ্ট বোঝা গেছে, গাজা ইস্যুতে হামাসের সাথেই বসতে হবে ইসরায়েলকে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের। ফলে গাজা থেকে হামাসকে নির্মূল করার যে লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করেছিল ইসরায়েল, তা ব্যর্থ হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
কমছে নেতানিয়াহুর সমর্থন
গাজায় সহিংসতা বন্ধ করতে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর প্রবল চাপ বজায় রেখেছে বৈশ্বিক নেতারা। তার জন্য এখন দুটি পথ খোলা আছে- হয় গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে অথবা সমঝোতার পথ বেছে নিতে হবে। সমঝোতার পথটা বেশ মসৃণ হবে না তার জন্য। বরং নিজের ঘরেই ঘোর বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারেন নেতানিয়াহু।
নভেম্বরে হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর ইসরায়েলের রাজনীতিতে ক্রমশ কমছে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা। অনেকেই বলছেন, এ যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট। অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকতে যুদ্ধটাকে তিনি বড় ইস্যু করে তুলেছেন।
এক্ষেত্রে নিজের অবস্থানে একেবারেই অনড় আছেন নেতানিয়াহু। হামাসকে নির্মূল করতে হবে- এ কথা বারবারই বলে যাচ্ছেন। রাফাহ শহরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত এসেছে সেই অবস্থান থেকেই। আর এ অভিযানের মাধ্যমে দ্বি-রাষ্ট্রিয় সমাধানকে সম্পূর্ণ অসম্ভব করতে তুলতে চান তিনি। এরপর গাজা এবং পশ্চিম তীরের মাঝে কোনো সম্পর্ক বাকি থাকবে না। তখনই বোঝা যাবে, নেতানিয়াহুর সামনে সমঝোতার পথ বাকি আছে কি নেই।
মিশরের টানাপড়েন
রাফাহ অভিযান বেশিকিছু দিক দিয়ে মিশরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কায়রোর সাথে তেল আবিবের সম্পর্কে বড় ধরনের ছাপ ফেলতে পারে এই অভিযান। শুধু তাই নয়, মিশরের ভেতরেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, হামাসের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে মিশরের চারভাগের তিনভাগ মানুষ। রাফাহ শহরে ইসরায়েলি অভিযানের ক্ষেত্রে মিশরের নীতিও একই ধরনের হতে পারে।
ইজিপশিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিসের প্রধান দিয়া রাশওয়ান জানিয়েছেন, সিনাই-গাজা সীমান্তের ফিলাডেলফি করিডরের ওপর ইসরায়েলের দখলদারিত্ব খুবই গুরুতর একটি বিষ্য। এতে কায়রো-তেল আবিব সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে।
শুধু তাই নয়, গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের ফলে মিশরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে মিশর। এছাড়া একইভাবে মিশরের সীমানার ভেতরেও ইসরায়েলি সৈন্যরা ঢুকে পড়বে কিনা, এমন প্রশ্নও জন্ম নিচ্ছে।
এছাড়া রাফাহ শহরে ইসরায়েলি সহিংসতার ফলে পুরো আরব অঞ্চলেই অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, এমনকি সরাসরি যুদ্ধও শুরু হতে পারে।
ইসরায়েলের ওপর যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষেত্রে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এতে সেনা অভিযান চালিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়ে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু।
রাফাহ অভিযানের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু
রাফাহ অভিযানের ফল যাই হোক না কেন, ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই একে দেখছে হামাস নির্মূলের একটি সুযোগ হিসেবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যান ‘বাইডেন ডকট্রিন’ নামের এক নীতির কথা বলেছিলেন। ইরান এবং তার মিত্রদের সরাসরি বিরোধিতা করা হয় এই নীতিতে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ডে এই নীতির প্রতিফলন দেখা যায়।
এই দুই দেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে মনে হয় যুদ্ধবিরতিতে তাদের আসলে তেমন আগ্রহ নেই। বরং রাফাহ অভিযানের দিকেই তাদের উৎসাহ বেশি।
গত সপ্তাহে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত নিজেদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে ইয়েমেনের আনসারাল্লাহ। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, রাফাহ অভিযান মাঠে গড়ালে আকাশপথ এবং পানিপথে হামলা বাড়িয়ে দেবে তারা। এমনকি বাবেল মানদেব প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে আনসারাল্লাহ। একইভাবে রাফাহ অভিযানের বিরোধিতা করে ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে লেবানন।
তাদের এসব হুঁশিয়ারি বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে যদি আসলেই এই অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। ফলে পুরো আরব অঞ্চলেই অস্থিরতা নতুন মাত্রা নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।