১৯৯০ সালের ৮ জুলাই। ১৮ বছরের জন্মদিন এসেছিল রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর।
১৯৯৬ সালের ৮ জুলাই। ২৪ বছরের জন্মদিন এসেছিল লর্ডসে টেস্ট অভিষেকে শতরানে নজর কাড়ার পর।
২০০০ সালের ৮ জুলাই। ২৮ বছরের জন্মদিন ছিল ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে স্মরণীয়।
২০১৬ সালের ৮ জুলাই। ৪৪ বছরের জন্মদিন আবার সিএবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম বার।
২০২০ সালের ৮ জুলাই। আজ, ৪৮ বছরের জন্মদিনও ব্যতিক্রমী, এ বার মাথায় বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের তাজ।
পরের বছর এই দিনে কি মহারাজকে দেখা যাবে অন্য ময়দানে, মাথায় অন্য শিরোপা নিয়ে? বাইশ গজের দুনিয়া থেকে রাজনীতির অঙ্গনে কি পা রাখবেন বাঙালির বড় আদরের ‘দাদা’? হয়ে উঠবেন এই রাজ্যে বিজেপির মুখ? পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকেই কি সামনে রাখতে পারে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল? আনন্দবাজার ডিজিটালকে ডোনা সরাসরি বললেন, “এখনও সৌরভ কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু ও যে পিচেই খেলুক না কেন, তাতেই সেরা হয়। হয়তো স্বাভাবিক অবস্থা থেকে শুরু করে, কিন্তু ঠিক শীর্ষে পৌঁছয়। যদি রাজনীতিতে যোগ দেয়, তা হলে আশা করছি হি উইল ফিনিশ দ্য টপ।” যা যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী।
সত্যজিতের ‘নায়ক’ সিনেমার অরিন্দমরূপী উত্তমকুমারের মুখে শোনা গিয়েছিল অমর সংলাপ। ‘আই উইল গো টু দ্য টপ’। ব্যাট হাতে বাঙালির রূপকথার নায়কও যেন সেই ইস্পাতকঠিন মননের অধিকারী। ডোনা তা মেনেও নিলেন, “হ্যাঁ, ওই ডায়লগ সৌরভের ক্ষেত্রে ভীষণ ভাবে প্রযোজ্য। ওর চরিত্রই এমন। যে কাজটাই করে, তাতেই সেরা হতে চায়। যখন সিএবি প্রেসিডেন্ট হল, তখন নানা আইনি জটিলতা। প্রথমে বিষয়গুলো ভাল করে বুঝতে শুরু করল। কার্যত গুলে খেল পুরো ব্যাপারটা। আইনি দিকগুলো তো আর রাতারাতি মা সরস্বতী এসে বুঝিয়ে দিয়ে যায়নি। (হাসি) ওকেই করতে হয়েছে আইনবিদদের সঙ্গে কথা বলে। এই পরিশ্রম সবাই করতে চায় না, পারেও না। কামব্যাক করার সময়ের ওর খাটাখাটনি যেমন। উন্নতি করার যে তাগিদ আর আত্মবিশ্বাস রয়েছে, তাতে আমি নিশ্চিত যে যদি সাধারণ এক জন হিসেবেও কোনও কাজ শুরু করে, তবে সেরাটা হয়েই শেষ করবে সৌরভ। হি উইল এন্ড আপ বিয়িং দ্য বেস্ট। অন্যরা যা করতে পেরেছে, তার চেয়ে ভাল ভাবে করবে। এটা ওর মধ্যেই রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ভাগ্যটাও বড় ব্যাপার। যা কিন্তু সৌরভের সঙ্গে খুব ভাল ভাবে যায়। হি হ্যাজ হিজ ওন লিগ।”
যখন নেতৃত্ব থেকে অপসারিত, জাতীয় দল থেকে বিতাড়িত সৌরভ ফেরার লড়াইয়ে দৌড়ে বেরিয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের মঞ্চে। এত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দামামার মধ্যে কাটানোর পর নিস্তরঙ্গ ডোমেস্টিক সার্কিটে খুঁজে নিয়েছেন অনুপ্রেরণা। পাঁচতারা হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত মনকেও মানিয়ে নিয়েছেন ছোট শহরের সাদামাটা হোটেলে। নিয়েছেন ফিটনেসের চ্যালেঞ্জ। সকাল-বিকেল ইডেন-রেলের মাঠে দৌড়, কখনও পিঠে প্যারাশুট বেঁধেও। ডোনার কথায়, “নিজের উপর বিশ্বাস ওর বরাবর। মনে করত, জাতীয় দলে খেলার ক্ষমতা আছে। আর সেই কারণেই লড়েছে। মনে রাখতে হবে, তার আগে সৌরভ জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন ছিল। বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে। অথচ, বাদ যাওয়ার পর খেলতে হয়েছে ফাঁকা মাঠে, দর্শকদের ছাড়া। পরিচিত ছিল ফাইভ স্টার হোটেলের জীবনের সঙ্গে। সেখান থেকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে খেলেছে, এমন সব মাঠে নেমেছে যেখানে ঠিকঠাক ড্রেসিংরুম পর্যন্ত নেই। এমসিজি, লর্ডসের মতো মাঠে খেলার পর এগুলোতে খেলা সহজ নয়। সৌরভ এমনই। আর এটা শুধু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও ও মানিয়ে নিতে পারে।”
তার মানে রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা থাকছেই কোথাও? আর যদি রাজনীতিতে আসেন, তা হলে শীর্ষপদেই দেখা যাবে সৌরভকে? এ বার রক্ষণ জমাট, ডোনা বললেন, “আমি বলছি না যে সৌরভ রাজনীতিতে আসছেই। তবে ও যদি রাজনীতিতে যোগ দেয়, শীর্ষে থাকার জন্যই করবে। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ও শীর্ষে থেকেছে। যে কাজটাই করেছে, তাতে সেরার জায়গাতেই থেকেছে। যদি রাজনীতিতে আসে, তা হলেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? এই তো আগের বার যখন দিল্লি ক্যাপিটালস দলের দায়িত্ব নিল, তখন কি কেউ আশা করেছিল যে ওরা প্রথম চারের মধ্যে থাকবে আইপিএলে? যে কাজটাই করে, তাতে নীচের দিকে থাকলেও ঠিক উপরে চলে আসে। এটা স্বভাবের মধ্যেই ঢুকে গিয়েছে। কারও পিছনে থাকতে পারে না। তবে আবার বলছি, রাজনীতি নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সৌরভ।”
বেহালা চৌরাস্তার বাড়িতে অবশ্য জন্মদিনে রাজনৈতিক জল্পনার প্রবেশাধিকার নেই। নেই বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে একসঙ্গে মুহূর্ত কাটানোর অবকাশ। করোনাভাইরাস ও লকডাউনের জোড়া ফলায় জন্মদিন পালন একান্তই ঘরোয়া। তবে বাঙালির অকৃত্রিম ভালবাসার পায়েস থাকছেই মেনুতে। এমনকি, মঙ্গলবার থেকে বাড়িতে পায়েস পাঠিয়েও দিয়েছেন ভক্তদের কেউ কেউ। ডোনা বললেন, “এ বার তো কিছু করার উপায় নেই। চারদিকে যা অবস্থা। মানুষের জীবন সবার আগে। অন্য বার আমাদের বাড়িকে অনেকে আসেন। সৌরভেরও ভাল লাগে পরিচিতদের সঙ্গে সময় কাটাতে। কিন্তু এ বার সে সব হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমার শাশুড়ি মা বয়স্কা। পাশেই আমার বাবা-মা আছেন। বয়স্কদের কথা ভেবেই আমাদের সাবধানী হতে হচ্ছে। ইচ্ছা থাকলেও স্পেশ্যাল যে কিছু করব, তার উপায় নেই।” সে দিক দিয়েও এ বারের জন্মদিন ব্যতিক্রমী।
ডোনার মনে আছে আর এক অন্য রকমের জন্মদিনের কথা। বললেন, “সে বার ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের জন্য আমরা শ্রীলঙ্কায়। কলম্বোর হোটেলে রয়েছি। ম্যাচ চলছে। খেলা শেষের পর সন্ধেবেলায় হোটেলে ফিরে পুরো টিমকে নিয়ে কেক কেটেছিল সৌরভ। কেক কাটার সময় সবাই ছিল বলেই ওটা স্পেশাল। হোটেলের ম্যানেজার তার পর পার্টি দিয়েছিল। খুব মজা হয়েছিল তার পর। এমনিতে এই সময় অনেক বার ইংল্যান্ডে সিরিজ থাকত সৌরভের। কখনও আমরাও থাকতাম ইংল্যান্ডে। আবার আমরা দেশে ফেরার পর জন্মদিন পড়ার ঘটনাও ছিল। তখন একলাই পালন করেছিল জন্মদিন।”
ব্যাট হাতে দাদাগিরির সেরা মুহূর্ত বাছতে হলে লর্ডসে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে জার্সি খুলে ওড়ানোর ছবি চোখে ভেসে ওঠে ডোনার। বললেন, “প্রথম প্রথম আমারও খারাপ লেগেছিল জামা খুলে ওড়ানো দেখতে। পরে ব্যাপারটা ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে, জামা খুলেছে, বেশ করেছে। ইট ওয়াজ ভেরি গুড স্টেটমেন্ট। সামবডি হু ডিড দ্যাট ইন লর্ডস। আর ওটা কিন্তু শুধু আমাদের দেশেই সাড়া ফেলেছিল তা নয়। তার বাইরেও সবাই মনে রেখেছে। এই তো এটিকে যখন তৈরি হল, তখন আমরা মাদ্রিদে গিয়েছিলাম। সেখানে রিয়াল মাদ্রিদ আর আটলেটিকো মাদ্রিদের ম্যাচের ফাঁকে সৌরভকে এটিকের অন্যতম মালিক হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছিল। সেখানে পর্দায় ওই জামা ঘোরানোর ছবিই দেখানো হচ্ছিল। ওরা তো খুব একটা ক্রিকেটের খবর রাখে না। তা ওখানকার লোকেরা সৌরভকে ওই ছবিটার মাধ্যমেই মনে রেখেছিল।” আসলে সৌরভের সেই ছবি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতীকী। ঐতিহাসিক কারণেই ব্রিটিশদের প্রতি অসন্তোষ রয়ে গিয়েছে স্পেন, ফ্রান্সের মতো দেশের। যাদের অপছন্দের তালিকায় ইংরাজি ভাষাও। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে লর্ডসে ফুটবলের স্টাইলে সুরভিত সেলিব্রেশন তাই মন ছুঁয়ে গিয়েছিল ইউরোপের অন্য দেশগুলোর। সৌরভের সঙ্গে কোথাও গিয়ে জন্ম নিয়েছিল একাত্মতা। মাদ্রিদে পাওয়া অভ্যর্থনায় সেটাই প্রতিফলিত।
অজস্র মনে রাখার মতো ইনিংস উপহার দিয়েছেন সৌরভ। তবু, যদি বেছে নিতে হয় কোনও একটাকে, হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের, কোনটা থাকবে শীর্ষে? এ বার ডোনা যেন সৌরভের টিম ইন্ডিয়ারই একজন। যাঁর কাছে ব্যক্তিগত কীর্তির চেয়ে দলগত সাফল্য থাকবে এগিয়ে। বললেন, “যে ইনিংস দেশের কাজে এসেছে, জয় এনে দিয়েছে, সেটাই সেরা। তা সব সময় বড় ইনিংস হতে হবে, এমন নয়। তবে সেটা যেন দলকে জেতাতে পেরেছে। এমন ইনিংসই আমার প্রিয়। তাই ফেভারিট হিসেবে কোনও একটা ইনিংসের কথা বলছি না। ফিফটি-সিক্সটি বা হানড্রেড, যেটাই করুক, দলকে জেতালেই তা আমার ভাল-লাগার। লাস্ট ওভারে কিছু রান বা একটা ছয় মারলেও তা গুরুত্বপূর্ণ, যদি দল জেতে। দেশকে জেতানো প্রতিটা ইনিংসই গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা কথা মানতেই হবে, অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি না পেলে তো এত দূরে আসতেই পারত না। লর্ডস ও ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, এই দুটো টেস্ট সেঞ্চুরির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে লর্ডসেরটা। ওটা না হলে পরেরগুলো হতই না! তার পরে অনেক ভাল ইনিংস দিয়েছে। ক্যাপ্টেন হিসেবে অনেক সোনার মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। তবে লর্ডসের সেঞ্চুরির মেজাজই আলাদা।” সৌরভও বার বার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির কথাই বলে থাকেন। তা সে যতই ক্রিকেট কেরিয়ারে থাকুক আরও হাজার মণি-মুক্তো।
সৌরভ মানেই কামব্যাক ম্যান। ছিটকে গিয়েও ফিরে আসা। যাবতীয় প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে, হার-না-মানা জেদ সঙ্গী করে, স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে। এই মানসিক জোরের উৎস কী? ডোনা বললেন, “নিজের উপর বিশ্বাস। আমি যদি ভাল হই, ঠিক ফিরতে পারব— এই বিশ্বাসটা রাখা। আমাকে ভুল কারণে ব্রাত্য করে রেখেছে, আমি আবার ফেরত যাব। এটাই মারাত্মক শক্তি। গ্রেগ চ্যাপেল যখন বাদ দিল, তখন ও দেশের সেরা ক্যাপ্টেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রচুর রান করে ফেলেছে। যদি আর দেশের হয়ে না-ও খেলত, তা হলেও খুব তফাত হত না।”
সেই সময় সৌরভ ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, জাতীয় দলের হয়ে খেলার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। আর সেই বিশ্বাসই ফেরার লড়াইয়ে মনের মধ্যে জ্বলন্ত মশাল হয়ে পথ দেখিয়েছিল। ডোনার মতে, “অত্যন্ত পজিটিভ একটা মানসিকতা রয়েছে ওর। তা বলে কি কখনও হতাশ হয় না? সৌরভও তো মানুষ। ওরও খারাপ লাগত, কষ্ট পেত, হতাশা আসত। কিন্তু পরের দিন তা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াত। এখানেই ওর বিশেষত্ব। এখানে আশপাশের লোক, পরিবারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তখন পাশে থাকতাম। আর ও তো অনেক সাফল্য তত দিনে পেয়ে গিয়েছিল। অনেক বড় বড় রেকর্ডও করে ফেলেছিল। ওটা একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল যে যদি জাতীয় দলে ফিরতে নাও পারি এগুলো ঠিক থাকবে। গ্রেগ চ্যাপেলের মতো লোকরা, যাঁরা বাদ দিয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা ওর বরাবরই ছিল। একটা লড়াকু ভাব সব সময়ের সঙ্গী। অনেকটা, ‘ঠিক আছে দেখে নেব, খারাপ হলে খারাপ হবে’ ধরনের মানসিকতা। অনেকে এই পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেয়। হতাশা গ্রাস করে ফেলে। কেউ কেউ তো আত্মহত্যাও করে ফেলে। সৌরভ কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া। ও মারাত্মক পরিশ্রম শুরু করে দিয়েছিল। নিজের যেটা দুর্বল জায়গা, সেটা নিয়েই পরিশ্রম করেছিল। সেটাকেই শক্তিশালী করে তুলেছিল। ও তো সর্বোচ্চ পর্যায়ে দীর্ঘ দিন খেলেছে। কোনও দিন রান করেছে, কোনও দিন শূন্যও করেছে। সেটা থেকেই হয়তো এই মানসিকতা এসেছে যে যা হয়েছে, তা হয়ে গিয়েছে। পরের সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। তখন হানড্রেড করতে হবে। সেটাও তো হবে, তাই না?”
অর্থাৎ, পজিটিভ থাকার মন্ত্রকে নিজের সুরক্ষা বিমা করে ফেলা। যেখানে নেতিবাচক তরঙ্গ স্রেফ ধাক্কা খেয়েই ফিরবে। ইস্পাতকঠিন সেই মননেই ফের আলো ফেললেন ডোনা। বললেন, “সৌরভ বিশ্বাস করে যে পজিটিভ থাকলে ইতিবাচক ঘটনাগুলোই ঘটবে। আর নেগেটিভ ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলে নিজেরই ক্ষতি। ওর বড় গুণ হল নিজের ডিফেক্টগুলো ধরা আর সেটা নিয়ে মাজাঘাষা করা। এটা আমরা অনেকেই করি না। খেলা, কথা বলা, অভিনয়, প্রশাসনিক দায়িত্ব— সবগুলোতেই এটা করে। আগে ম্যাচের সেরা হয়ে যা বলত, তার থেকে এখন যেমন বিশাল ফারাক। বিশাল পার্থক্য। নিজেকে গড়ে তোলার এই মানসিকতা গ্রেগ চ্যাপেল জমানাতেই শুরু। নিজেকেই বলত যে, আমি যদি কামব্যাক করতে পারি তবে বাকি সব কাজও পারব। ওই কঠিন সময়ে লড়াই করে দলে ফেরা ওকে এমন শক্তি দিয়েছে যে আর সবকিছুই সহজ বলে মনে হয়।”
ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, প্রশাসক, টিভির সঞ্চালক। নানা জোব্বা উঠেছে সৌরভের গায়ে। ডোনা সবগুলোর মধ্যেই একটা মিল খুঁজে পাচ্ছেন। তা হল, উৎকর্ষের সন্ধানে নিরন্তর সাধনা। বললেন, “প্রতিটা ফরম্যাটেই কিন্তু ও ক্রমশ উন্নতি করে। এটা সবচেয়ে বড় কোয়ালিটি। যেটাই করুক, তাতে এগিয়ে যায়। কেউ জীবনে ভাবেনি যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সিএবিতে এসে এ ভাবে কাজ করবে। ভাবা হয়েছিল, সৌরভ ঘুরে-ঘুরে বেড়াবে। আর অন্যরা সিএবি চালাবে। ‘নাম কা ওয়াস্তে’ থাকবে সৌরভ। ও কিন্তু ভিতরে ঢুকে জেনেছে সব কিছু। সিএবি বা বোর্ড, সমস্ত আইনের ফাঁকফোকর এখন ওর জানা। অনেক উকিলের থেকেও সৌরভ বেশি জানে এখন। যখন ও সিএবি প্রেসিডেন্ট তখন কোনও ফান্ড আসত না বোর্ড থেকে। সৌরভ নিজে উদ্যোগ নিয়ে অনেক এন্ডডোর্সমেন্ট বাংলায় এনে, ফান্ডের ব্যবস্থা করে, স্পনসর এনে সিএবি চালিয়েছে। আবার দাদাগিরির প্রথম বছর দেখুন, ধারাভাষ্যকার হিসেবে শুরুটা দেখুন, ক্যাপ্টেন হিসেবেই দেখুন বা নিছক বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবেই দেখুন, ও কিন্তু প্রতিনিয়ত উন্নতি করেছে। প্রথমে যেগুলো সমস্যা ছিল, সে সব জায়গায় উন্নতি করে প্লাস পয়েন্টে পরিণত করেছে। যে কোনও ফিল্ডেই এটা ঘটে। অ্যাড ফিল্মেও দেখুন। গোড়ায় অজয় জাডেজার সঙ্গে যেটা করেছিল, তার চেয়ে এখন বিজ্ঞাপনে ওকে পুরো পেশাদার মনে হয়। এখন ২৫-২৬টা ব্র্যান্ড এন্ডোর্স করে। সবাই এটা করতে পারে না। বাকিরা যেটা ভাল পারে, সেটাই শুধু পারে। কিন্তু ও ভাবে যে এমন কিছু নেই যেটা পারবে না। যে কোনও কাজেই মোটামুটি একটা শুরু করলেও ফিনিশিংটা দারুণ করে। প্রথম যখন ক্রিকেট নিয়ে বলত, তখন অত ভাল বলত না। কিন্তু এখন ওই সেরা ধারাভাষ্যকার। সবাই পছন্দ করে। আর একটা কথা। যদি ও সত্যিই ভাল না হত, তবে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হতে পারত না। বাকিদের থেকে যোগ্য বলেই তো হয়েছে।”
এ বার কি সামনে আইসিসি প্রেসিডেন্ট? ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে পরের স্টেশন তো ওটাই? ডোনা এ বারও অফস্টাম্পের বাইরের বল না খেলে ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে। বললেন, “আমি সত্যিই জানি না। তবে গ্রেম স্মিথের মতো অনেক বিদেশিরাও তো চাইছে সৌরভকে। নিশ্চয়ই ওদের মনে হচ্ছে সৌরভ এটা পারবে। তবে আমি জানি না, এটা হবে কি না। এটা সৌরভই ভাল বলতে পারবে।”
কোন ভূমিকায় সৌরভকে দেখতে সবচেয়ে পছন্দ করেন? এ বার স্টেপ আউট করলেন ডোনা। বললেন, “আমার ক্রিকেটার, প্রশাসক ও ধারাভাষ্যকার, তিন ভূমিকাতেই ভাল লাগে। আগে টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন ছিল। এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। এখানেও ও-ই ক্যাপ্টেন। ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে বাকিরা। দায়িত্ব নিয়েই ইডেনে পিঙ্ক বল টেস্ট করেছিল। এখনও প্রতি মুহূর্তে বোর্ডের কাজকর্ম নিয়ে মেতে থাকে। যখন সিএবির দায়িত্বে এসেছিল, কেউ কেউ মনে করেছিল যে সৌরভকে সামনে রেখে কাজ চালাবে। তা হয়নি। তবে আমি বুঝতে পারি যে নিজে সবচেয়ে উপভোগ করত খেলাই। কারণ, তার সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। এত দেশ, এত রকমের বোলারকে বিভিন্ন পিচে, আলাদা আলাদা কন্ডিশনে সামলানোর মধ্যে ও মজা পেত। এখন উপলব্ধি করি যে অন্য কাজগুলো করতে গিয়ে অত মজা পায় না। তবে ক্রিকেটের কাজই তো করছে। কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছে।”
বাইশ গজের দাদাগিরির নেপথ্য রসায়নের খোঁজ দিলেন ডোনা। সেরা হওয়ার অদম্য তাড়নার রেসিপিও তুলে ধরলেন। থাকল কিছু ইঙ্গিতও। কে বলে ক্রিকেটই শুধু অনিশ্চয়তার খেলা!