১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর উরুগুয়ে থেকে চিলির উদ্দেশে রওনা দেয় ‘ফ্লাইট-৫৭১’। বিমানে ছিলেন উরুগুয়ের ওল্ড ক্রিশ্চিয়ানস ক্লাবের রাগবি দলের খেলোয়াড় এবং সমর্থক-সহ মোট ৪৫ জন।
উড়ানের সময় আন্দিজ পর্বতের বুকে আছড়ে পড়ে যাত্রিবাহী ওই বিমান। মনে করা হয়, তুষারে ঢাকা আন্দিজ পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ঘন কুয়াশার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
ওই দুর্ঘটনায় ১২ জন বিমানযাত্রীর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। বরাতজোরে বেঁচে যান ৩৩ জন। তবে তাঁদের মধ্যে কয়েক জনের ভাগ্য বেশি দিন সহায় হয়নি।
সেই সময়ে গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তি এত উন্নত না হওয়ায় বেঁচে-যাওয়া বিমানযাত্রীদের খুঁজে বার করতে উদ্ধারকর্মীদের দু’মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। ৭২ দিন ধরে হিমশীতল আন্দিজ পর্বতের কোলেই বাস করতে হয়েছিল ওই ক’জনকে।
আন্দিজ পর্বতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১০ ডিগ্রি নীচে। শীতের পোশাক গায়ে থাকলেও সেই পোশাক ভেদ করে ঠান্ডা বিমানযাত্রীদের শরীর ছুঁতে শুরু করে।
বিমানে যে খাবার অবশিষ্ট ছিল, তা বেশ কিছু দিন ধরে ভাগ করে খেয়েছিলেন রক্ষা পাওয়া বিমানযাত্রীরা। কিন্তু এক সময় সেই সঞ্চয় ফুরোয়। জলের সঞ্চয় ফুরিয়েছিল তারও আগে।
দুর্ঘটনায় পাওয়া আঘাত থেকে এবং অক্সিজেনের অভাবে কিছু দিনের মধ্যে মারা যান আরও ১৭ জন যাত্রী। ৪৫ জনের মধ্যে থেকে গিয়েছিলেন মাত্র ১৬ জন।
খাদ্য এবং জলের ভাঁড়ার শূন্য হতে ভয় জমতে শুরু করে আটকে পড়া যাত্রীদের মনে। শেষে খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এক চরম সিদ্ধান্ত নেন বেঁচে যাওয়া ওই ১৬ বিমানযাত্রী। যে সিদ্ধান্তের কথা শুনলে ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায়।
খিদের তাড়নায় বরফের মধ্যে পড়ে থাকা সঙ্গীদের মৃতদেহ থেকে মাংস খুবলে নিয়ে খেতে শুরু করেন জীবিত ১৬ জন।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাড়নায় সমাজের সমস্ত রীতি-নীতি-সংস্কারের বেড়া টপকে গিয়েছিলেন ওই ১৬ জন।
সেই মাংস বিস্বাদ লাগা সত্ত্বেও বা খাওয়ার সময় ঘেন্না হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে থাকার তাগিদে বন্ধুদের মৃতদেহকে ‘পরমান্ন’ মনে করে খেয়ে যেতে হয়েছিল দীর্ঘ দিন।
বেঁচে যে বাড়ি ফিরবেন, সেই আশাও ধীরে ধীরে ত্যাগ করতে শুরু করেন ওই ক’জন। কে আগে মারা যাবে! সকলের মধ্যে কাজ করছিল সেই ভয়ও। কারণ, সকলেই জানতেন, যিনিই মারা যাবেন, তাঁর দেহ বন্ধুদের ক্ষুধা নিবারণের কাজে লাগানো হতে পারে।
বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে ৮ ডিসেম্বর দুর্ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। উদ্ধার করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জীবিত বিমানযাত্রীদের।
চলতি বছরে সেই ঘটনার ৫০ বছর পূর্ণ হল। আন্দিজ থেকে বেঁচে ফিরে আসার পর নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর গল্প বহু জায়গায় অনেক বারই শুনিয়েছেন ওই বিমানযাত্রীরা।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা বিমানযাত্রীর মধ্যে ছিলেন রবার্তো কানেসা। ২০১৬ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, এত বছর পরও ওই ঘটনার স্মৃতি এক ফোঁটা ঝাপসা হয়নি তাঁর স্মৃতিতে।
পেশায় চিকিৎসক রবার্তো তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘আই হ্যাড টু রেসকিউ: হাউ প্লেন ক্র্যাশ ইন দ্য আন্দিজ ইন্সপায়ার্ড মাই কলিং টু সেভ লাইফ’ নামে একটি বই লিখেছেন। রবার্তোর কথায়, ‘‘সে সময় এমন কাজ করেছি, যা হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে দুঃস্বপ্ন!’’
ওই ঘটনা নিয়ে লেখক পিয়ার্স পল রিডও লিখেছিলেন বেস্ট সেলিং বই, ‘অ্যালাইভ: দ্য স্টোরি অফ দ্য আন্দিজ সারভাইভার্স’। পরবর্তী কালে সেই বই থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিও তৈরি হয়।