মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কারাবন্দী ছাত্রনেতা, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক বর্ষীয়ান আইনজীবী ও এ দেশের সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু জীবনের পড়ন্ত বেলায় রবিবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তাঁর নিজের নাম দেখে বলেছেন, আমি লজ্জিত, বিস্মিত ও হতবাক।
নজিরবিহীন এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে কাজ করেছে তা সবার জন্য বিস্ময়কর, লজ্জাজনক। আর এর মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম যথাযথভাবে হচ্ছে না। এর পরিণতিতে এভাবে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে এ কাজটি করেছে। তিনি আরও বলেন, তাদের লক্ষ্য হলো, আমার নামে কালো দাগ লাগানো। মানুষের কাছে খারাপভাবে তুলে ধরা- এটা রাজাকারদেরই কাজ। তা ছাড়া শুধু আমি নই, রাজশাহীর আরও তিনজনের নাম এসেছে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। যাদের রাজনীতি, কাজ সবার জানা। এ ঘটনায় দেশের নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত। এর দায়ভার তাদের নিতে হবে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে যাঁর ভূমিকা ছিল তাঁকে কারা, কেন এ তালিকায় নিয়ে এসেছে এর তদন্ত করে জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে।
’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় রাজশাহীর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম আরিফ টিপু। এ সময় তিনি দীর্ঘদিন কারাবন্দী ছিলেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিতীয় কমিটিতে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন সভাপতি ও গোলাম আরিফ টিপু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন তিনি।
তিনি ’৭০ ও ’৭৩ সালে ন্যাপের কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। নানা লোভ-প্রলোভনের মুখেও তাঁর আদর্শিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সব সামরিক ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তৎকালীন ১৫ দলের অন্যতম নেতা গোলাম আরিফ টিপু অনেকবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। অনেকবার রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব নেতা-কর্মী ছাত্র-শিক্ষক যখন ওয়ান ইলেভেনের স্বৈর সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাবন্দী হন তখন তাঁদের পক্ষে তিনি আইনি লড়াই চালিয়েছেন। পরে ঢাকায় এসে এই প্রখ্যাত ডিফেন্স কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রহসনের মামলায় তাঁর পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন। তারুণ্যে দেশের একজন খ্যাতিমান ফুটবলার ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালের পর রাজনীতি থেকে অবসরে যান। তিনি বার কাউন্সিলের সদস্যও ছিলেন।
রাজশাহীতে প্রতিবাদ
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে নাম আছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুসহ পাঁচজনের। এ পাঁচজন এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। আবার তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট মহসিন আলীর নামও আছে সেই তালিকায়। আবদুস সালামের পরিবারের পাঁচজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হন।
প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় রাজশাহী বিভাগের ১ থেকে ১৫৪টি তালিকা আছে। এ তালিকায় রাজশাহী বিভাগের রাজাকারদের তালিকায় যে নামগুলো আছে ৮৯ নম্বরে থাকা পাঁচজনের মধ্যে অন্য দুজন হলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ ও পুলিশ কর্মকর্তা এস এস আবু তালেব। যদিও এই ৮৯ নম্বর তালিকার মন্তব্যের ঘরে লেখা আছে তাদের অব্যাহতি দিতে জেলা কমিটি আবেদন করেছিল।
ভুলেভরা রাজাকারের তালিকা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভাষাসংগ্রামী ও একুশে পদক পাওয়া গোলাম আরিফ টিপুর নাম তালিকায় দেখে ক্ষোভে ফুঁসছেন রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষ। রাজশাহীতে ভাষাশহীদদের সম্মানে যে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম আরিফ টিপু।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গোলাম আরিফ টিপু ও আবদুস সালাম হচ্ছেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তাঁদের নাম এ তালিকায় আসা শুধু হাস্যকরই নয়, সমগ্র জাতির জন্য লজ্জাজনক। আমি যারা এ তালিকা তৈরি করেছেন তাদের দোষ স্বীকার করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।’ রাজশাহী সদর আসনের এমপি ও ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘গোলাম আরিফ টিপু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের সঙ্গে আছেন। ঊনসত্তরের আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নাম এ তালিকায় রাখা রাজনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। এভাবে তালিকা প্রকাশ করা উচিত হয়নি।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘গোলাম আরিফ টিপুর মতো বড় মুক্তিযোদ্ধা এ অঞ্চলে আর কেউ নেই। এটা শুধু হাস্যকর নয়, জাতির জন্য কলঙ্কজনক। উনার মতো এত বড় দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠকদের একজন, তাঁকে এভাবে জীবিত অবস্থায় অপমানিত করে ১৬ কোটি মানুষকে অপমানিত করা হলো।’
মুক্তিযোদ্ধা সাবেক মেয়র আবদুল হাদী বলেন, ‘তালিকায় যাদের নাম আছে, তাদের কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠক ছিলেন। তাদের নাম এ তালিকায় আসা দুঃখজনক।’ মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, ‘তালিকাটি করতে দীর্ঘদিন ধরে তারা ও শহীদদের সন্তান দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এমন একটি তালিকা প্রকাশ করা হলো, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি করল।’
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু রাজশাহী সফরে এসে উঠেছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের বাড়িতে। সেখানে তিনি বসে নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর নাম এ তালিকায় থাকায় ক্ষোভ জানিয়েছেন আবদুস সালামের জামাতা আরিফুল হক কুমার। তিনি বলেন, ‘এটি ভুল করে হয়েছে- এমনটা আমরা মনে করি না। প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতি চক্র এটি করেছে।’ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. আবদুল মান্নান বলেন, ‘যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, তাঁদের নাম এ তালিকায় আসার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। দ্রুত নামগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। সেই সঙ্গে এই নাম প্রকাশের পেছনে যাদের ইন্ধন আছে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
রাজশাহী থিয়েটারের সাবেক সভাপতি কামার উল্লাহ সরকার বলেন, ‘গোলাম আরিফ টিপু, আবদুস সালাম ও অ্যাডভোকেট মহসিন রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যতম শক্তি। তাঁদের নাম এ তালিকায় থাকা মানে, আমরা যে বলছি, জামায়াতি ছকে চলছে দেশ- এটি তার প্রমাণ।’
রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের দাবি, এ তালিকা ভুলেভরা। কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই নামগুলো তুলে ধরা হয়েছে। রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, ‘আমি জানি রাজশাহীর অন্যতম রাজাকার ছিলেন অ্যাডভোকেট আফাজ উদ্দিন ও শান্তি কমিটির সভাপতি আয়েন উদ্দিন। কিন্তু তাদের নাম যদি রাজাকারের তালিকায় না থাকে তাহলে খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আবার যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এসব ব্যক্তির নামও যদি এ তালিকায় থাকে, তাও হবে চরম লজ্জাজনক। কেন তাঁদের নাম এ তালিকায় উঠে এলো, কোন প্রসঙ্গে এলো তা বিস্তারিত উল্লেখ নেই।’